>>>> প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলো কি সর্ম্পূণ সুদমুক্ত হতে পেরেছে? <<<<
ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন করা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তাদের মাঝে চাপ প্রয়োগ করা। একটি ইসলামী ব্যাংকের মান যাচাই এর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত চলকগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে -
১) শরীয়াহ বোর্ডের সদস্য কারা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তারা কতটুকু কঠোর?
২) ব্যাংকের কর্মচারীরা কতটুকু ইসলামিক। তারা নিয়মিত সালাত আদায় করে নাকি, মহিলা কর্মচারীরা পর্দা মেনে চলেন নাকি, নারী পুরুষের অবাধ এবং অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা হয় নাকি এবং সবচেয়ে বড় কথা হল তারা সুদের পাপের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে নাকি! সুদের প্রতি ঘৃণা একজন ইসলামী ব্যাংকারের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ।
৩) ব্যাংকের কর্মচারীরা ইসলামী অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত কিনা এবং এটাকেই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি মনে করেন কি না?
৪) ব্যাংকের কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না?
অতএব, উপরোক্ত আলোচনায় বলা যায় যে, ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত ইসলামী ব্যক্তিত্ব। আর সেটার চরম অভাব আমাদের দেশে রয়েছে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে বিশাল অজ্ঞতার কারণে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে সচেতনতা ব্যাংকগুলোকে সেবার মান বৃদ্ধি করতে বাধ্য করবে।
এক নজরে ইসলামী ব্যাংকের হালাল-হারামের চিত্র নিম্নরূপ-
১. মুরাবাহা ক্রয়-বিক্রয়ের বিপরীত আয় - সুদ/হারাম
২. হায়ার পার্চেজ বিনিয়োগের বিপরীত আয় - সুদ/হারাম
৩. বৈদেশিক বাণিজ্যের বিপরীতে আয় - সুদ/হারাম
৪. ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে কমিশন - সন্দেহজনক/হারাম
৫. বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত বাধ্যতামূলক রিজার্ভের বিপরীতে অর্জীত আয় - হারাম
৬. কল মানি মার্কেটের আয় - সুদ / হারাম
৭. ক্রেডিট কার্ড এর বিপরীতে অর্জীত মুনাফা - সুদ / হারাম
৮. রিক্স ফান্ড বাবদ কমিশন - নাজায়েয
৯. লকার সার্ভিসের বিপরীতে আদায়কৃত ভাড়া - হালাল
১০. ডি.ডি.টি.টি - সহ অন্যান্য সার্ভীসচার্জসমূহের বিপরীতে প্রাপ্ত কমিশন/আয় - হালাল
প্রচলিত সুদী ব্যাংকসমূহেরও উপরোক্ত দু’প্রকার আয় হালাল। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব কোন কৃতিত্ব নেই।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে যা বুঝা যায়, হালাল-হারাম বিবেচনায় ইসলামী ব্যাংকের আয় এবং প্রচলিত সুদী ব্যাংকের আয়ের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। অতএব, ইসলামী ব্যাংক ও সুদী ব্যাংকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
শুধুমাত্র পার্থক্য এতটুকুই যে, প্রচলিত সুদী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের মত ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতির পরিভাষা গুলো ব্যবহার করে না আর ইসলামী ব্যাংক তা করে থাকে। আরেকটি পার্থক্য হলো এই যে, প্রচলিত সুদী ব্যাংকের শরীয় কাউন্সিল নেই কিন্তু ইসলামী ব্যাংকে নামমাত্র এই শরীয়া কউন্সিল রয়েছে বলা যায়। যেমন পরিভাষা গুলো নিম্নরূপ -
১. মুদারাবা
২. মুশারাকা
৩. বায়ই মুরাবাহা
৪. ব্যয়–ই–সালাম: (অগ্রিম ক্রয়)
৫. ব্যয়–ই–মুয়াজ্জাল (বাকীতে বিক্রয়):
৬. ইজারা
৭. ইজারা বিল–বায়ই (ক্রয়ের চুক্তির ভাড়া):
৮. হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক (যৌথ মালিকানাভিত্তিক ভাড়ায় ক্রয়–বিক্রয়)
৯. কিস্তিতে বিক্রয়
১০. ইসতিসনা
১১. জু’আলাহ
১৩. মুশাকাত
১৪. শেয়ার ক্রয়–বিক্রয়
১৫. বৈদেশিক মুদ্রার উপস্থিত ক্রয়–বিক্রয়
১৬. মেয়াদী অংশগ্রহণকারী সার্টিফিকেট
১৬. বিনিয়োগ নীলাম
১৮. সরাসরি বিনিয়োগ
১৯. স্বাভাবিক মুনাফার হারে বিনিয়োগ
২০. করযে হাসানা
ইসলামী ব্যাংকগুলো মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে প্রতারণা করছে। তারা সাধারণ আমানতকারীর সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাস নষ্ট করছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ইসলাম নেই। এগুলো আমানত সংগ্রহ, বিনিয়োগ, বাণিজ্য কোনো ক্ষেত্রেই ইসলামিক ব্যাংকিং করছে না।
বর্তমানে আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদমুক্ত নয়। যার কারনে তাতে ফিক্সড ডিপোজিট বা সেভিংস একাউন্ট খোলা অন্যান্য ব্যাংকের মত নাজায়েয, যতক্ষণ না তারা তাদের সার্বিক কার্যক্রম ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালনা না করে। তবে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে কারেন্ট একাউন্ট খোলা জায়েয। আমার জানা মতে, আমাদের দেশের গ্রহণযোগ্য দারুল ইফতাগুলোর তাহক্কীক ও ফাতওয়া এমনই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বীমা বিভাগের অধ্যাপক এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ, বিনিয়োগসহ আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কোন সূচকেই ইসলামী ব্যাংকিং করছে না। তারা অন্যান্য ব্যাংকগুলোর মতো সুদ ভিত্তিক ব্যাংকিং করছে। এটা বিশ্বাসী আমানতকারির সঙ্গে প্রতারণা। তাদের বিশ্বাস নষ্ট করা।
তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোও পরিচালকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। কিছু বেশি দায় খয়রাত করে ইসলামী ব্যাংক হিসেবে ফায়দা নিচ্ছে। এটা ঠিক না। ইসলামী ব্যাংকিং হলো, পুঁজি সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দেয়া। সেটি করে না কেউ। কেউ মুদি দোকানি, কাজের লোক, বাদাম বিক্রেতাকে ঋণ দেয় না। এ বিষয়ে তিনি আরও মন্তব্য করে বলেন, ব্যাংকগুলো কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা করে না। বেতন কম দেয়। অন্যান্য ব্যাংকের থেকে সুযোগ সুবিধাও বেশি। এভাবে কেন চলবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলী বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো সঠিক পথে নেই। তারা ব্যবসা করতে মূলত এই ধরনের ব্যাংকিং করছে। ইসলামী ব্যাংকিং চর্চা কেউ করেন না। তিনি আরও বলেন, এমন উদাহরণও দেখেছি, ইসলামী ব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে ৪৫ শতাংশ হারে ঋণ নিয়েছে। এটা কোন ধরনের ইসলামি ব্যাংকিং। এগুলো কি প্রতারণা নয়। মানুষে ঠকানো নয়। সাবেক এই নির্বাহী বলেন, অনেক আমানতকারী বিশ্বাস করে বিনা মুনাফায় অর্থ রাখেন। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে এমন আমানত প্রায় ১৫ শতাংশ। কি হয় এসব অর্থের মুনাফা।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলো কি সর্ম্পূণ সুদমুক্ত হতে পেরেছে?
এই জনপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর হল না। ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদভত্তিকি র্অথনতৈকি ব্যবস্থার মাঝে র্কাযক্রম পরচিালনা করে বিধায় তারা দুটি ক্ষেত্রে সুদমুক্ত লনেদনে করতে পারে না -
১) কেন্দ্রীয় ব্যাংকরে সাথে যে বাধ্যতামূলক সঞ্চতি, (SRR) এবং Foreign Currency Clearing Account এ জমাকৃত বৈদশিক মুদ্রার উপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ দেয়।
২) বিদেশী ব্যাংকগুলোর সাথে ইসলামী ব্যাংকের যে Nostro Account থাকে, সেটা চলতি হিসাব হলেও Overnight lending থেকে তারা সেখান থেকে সুদ পায়। হাদীসে এসেছে -
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم إِنَّهَا سَتَأْتِي عَلَى النَّاسِ سِنُونَ خَدَّاعَةٌ يُصَدَّقُ فِيهَا الْكَاذِبُ وَيُكَذَّبُ فِيهَا الصَّادِقُ وَيُؤْتَمَنُ فِيهَا الْخَائِنُ وَيُخَوَّنُ فِيهَا الْأَمِينُ وَيَنْطِقُ فِيهَا الرُّوَيْبِضَةُ قِيلَ وَمَا الرُّوَيْبِضَةُ قَالَ السَّفِيهُ يَتَكَلَّمُ فِي أَمْرِ الْعَامَّةِ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মানুষের নিকট এমন ধোকাব্যঞ্জক যুগ আসবে, যাতে মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদীরূপে এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত করা হবে। যখন খেয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হবে এবং আমানতদার আমানতে খেয়ানত করবে। যখন জনসাধারণের ব্যাপারে তুচ্ছ লোক মুখ চালাবে।” [আহমাদ, হাঃ ৭৯১২, ইবনে মাজাহ, হাঃ ৪০৩৬, হাকেম, হাঃ ৮৪৩৯, সহীহুল জামে’, হাঃ ৩৬৫০, হাদীস সম্ভার, হাঃ ১৮৭৭] তাহক্বীক্ব : হাদীসের মান - সহীহ।
সুতরাং, উপরোক্ত হাদীসের আলোকে তাই বলা যায় যে -
(১) বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের নামের পূর্বে শুধু ইসলাম শব্দটি বাকী আছে। এর আভ্যন্তরীণ কর্মকান্ডে ইসলামী আদর্শের নাম নিশানাও নেই।
(২) ইসলামী ব্যাংকের ম্যানুয়েল, বই-পস্তক, গাইড লাইন ইত্যাদিতে কুরআন-সুন্নাহ’য় বর্ণিত ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূলনীতিসমূহ লিখিত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তব কর্মের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
(৩) ইসলামী ব্যাংকের বাহ্যিক দিকটা অত্যন্ত সৌন্দর্যমন্ডিত, চাকচিক্যময় হলেও এর ভেতরটা হচ্ছে হিদায়াত ও আল্লাহ ভীতি শূণ্য।
(৪) আর হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী যেসব আলেম দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে ইসলামের অকাট্য হারাম বিধান সুদকে হালাল বলে ফতোয়া দেয় যা ছিল ইহুদী - খৃষ্টানদের ধর্মগুরু আহবার-রুহবানদের কাজ! তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীর প্রাণী আর কিছু হতে পারে না। এ জাতীয় দুনিয়া ও অর্থপূজারী আলেমদের কারনেই ইসলামী ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্সের নামে ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলো সুদকে হালাল করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে।
(৫) নিঃসন্দেহে বর্তমান যামানার জন্য এটা এক মহা-ফেতনা। কেননা আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল এবং হালালকৃত বিষয়কে হারাম করা ইসলামের নামে বড় ধরনের ফেতনা ছাড়া কিছুই নয়। এ ফেতনার কবলে পড়ে ঈমান হারাতে পারেন যে কেউ আর এসব ফেতনায় পড়েই আলেমদের ধ্বংসের কথা উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
বস্তুতঃ প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উক্ত আমল যতই সৌন্দর্য, আকর্ষনীয় ও জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হোক না কেন তা কোন অবস্থাতেই আল্লাহর নিকট গ্রহনীয় হতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টই বলেছেন যে,
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا
বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকদের কথা জানাব, যারা আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ’?
الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا
দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করছে যে, তারা ভাল কাজই করছে’!
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا
‘তারাই সেসব লোক, যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে। ফলে তাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে গেছে। সুতরাং আমি তাদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন ওজনের ব্যবস্থা রাখব না’। (সূরা কাহাফ : ১০৩ - ১০৫)
আল্লাহ তা’আলা আমদেরকে হেফাযত করুন, আমীন।
0 Comments