Header Ads Widget

Responsive Advertisement

চোগলখুরী, গীবত, ও পরনিন্দা



>>> চোগলখুরী, গীবত, ও পরনিন্দা <
আখলাকে সায়্যিয়াহ বা মন্দ চরিত্রের একটি হলো গীবত বা চোগলখুরী করা। চোগলখুরী মানে এক জনের কথা অন্য জনের কাছে লাগিয়ে দেয়া। অন্য অর্থ নিন্দুক, বিবাদ সৃষ্টিকারী, গীবতকারী। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন; মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;
أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ مَا الْعَضْهُ هِيَ النَّمِيمَةُ الْقَالَةُ بَيْنَ النَّاسِ‏
সাবধান! আমি তোমাদের জানাচ্ছি [عَضْهُ] চোগলখুরী কী? এ হচ্ছে একের কথা অপরকে লাগিয়ে বেড়ান, যাতে মানুষের মাঝে বৈরিতার সৃষ্টি হয়। (সহীহ মুসলিম: ৬৫৩০)


ইমাম বুখারী আচার ব্যবহার অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, চোগলখুরী নিন্দিত গুনাহ। আর ইমাম মুসলিম কিতাবুল ঈমান অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, চোগলখুরী জঘন্যতম হারাম। হাদীসে নমীমাহ শব্দটি এসেছে। নমীমাহ বলা হয়, যে ব্যক্তি একের কথা অপরের নিকট বলে বেড়ায় পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করার উদ্দেশে। 
.
এ সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে;
وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَهِينٍ هَمَّازٍ مَشَّاءٍ بِنَمِيمٍ مَنَّاعٍ لِلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ
আর তুমি আনুগত্য করবে না প্রত্যেক এমন ব্যক্তির যে অধিক শপথকারী, লাঞ্ছিত। পিছনে নিন্দাকারী, যে একের কথা অপরকে লাগিয়ে বেড়ায়। যে কল্যাণের কাজে বাধাদান করে, যে সীমালংঘনকারী, পাপিষ্ঠ। রূঢ় স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত। (আল-ক্বালাম, ৬৮/১০-১৩)
وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ 
দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পিছনে ও সামনে লোকের নিন্দা করে। (আল-হুমাযাহ, ১০৪/১)
.
এই আয়াতে ‘হুমাযাহ’ ও ‘লুমাযাহ’ দু’টি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দ্যশ্য হলো: অপবাদদানকারী ও গীবত তথা পরনিন্দাকারী। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে هُمَزَة এর অর্থ গীবত অর্থাৎ পশ্চাতে পরনিন্দা করা এবং لُمَزَة এর অর্থ সামনা-সামনি দোষারাপ করা ও মন্দ বলা। এ দুটি কাজই জঘন্য গোনাহ। কাতাদাহ বলেন; هُمَزَة ও لُمَزَة অর্থ মুখের কথায় ও চোখের ইশারায় মানুষের মনে কষ্ট দেয়া কখনো গীবত করে, কখনো বা অপবাদ দিয়ে হয়। অনেকের মতে; هُمَزَة হাত ও চোখের দ্বারা নিন্দা করে হয় এবং لُمَزَة জিহ্বা দ্বারা সামনা-সামনি দোষারাপ করে হয়। পশ্চাতে নিন্দা করা বড় অন্যায় তাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানতেও পারে না যে, তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে। ফলে সে নিজের পক্ষে সাফাই করার সুযোগ পায় না। আবার সম্মুখের নিন্দা গুরুতর। যার মুখোমুখি নিন্দা করা হয়, তাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হয়। এর কষ্টও বেশি, ফলে শাস্তিও গুরুতর। 
.
আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;
وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَيَّ الْمَشَّاءُونَ بِالنَّمِيمَةِ الْمُفَرِّقُونَ بَيْنَ الأَحِبَّةِ الْمُلْتَمِسُونَ لِلْبُرَاءِ الْعَنَتَ الْعَيْبَ
আর তোমাদের মাঝে সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যক্তি হলো যে একের কথা অপরকে লাগিয়ে বেড়ায়, অপরের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ঘটায় এবং নির্দোষ লোকেদের মাঝে দোষ খুঁজে বেড়ায়। (ত্বাবারানী: ৮৩৫)
.
হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বললেন; আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি;
 لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ 
কাত্তাত (যে একের কথা অন্যের কাছে লাগিয়ে বেড়ায় সে) জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহুল বুখারী: ৬০৫৬, সহিহ মুসলিম: ১৯২, ১৯৩)
.
চোগলখুরী এমন গুনাহ যার কারণে কবরে আযাব হয়। মুতাওয়াতির হাদীসে এসেছে;
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ مَرَّ النَّبِيُّ ﷺ بِقَبْرَيْنِ فَقَالَ ‏"‏ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ، وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنَ الْبَوْلِ، وَأَمَّا الآخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ ‏
ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) একবার দু’টি কবরের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি বললেন; তাদের দুজনকে আযাব দেওয়া হচ্ছে, কোন বড় পাপের জন্য আযাব দেয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব থেকে সতর্ক থাকত না আর অপরজন চোগলখুরী করতো (একের কথা অপরকে লাগিয়ে বেড়াত)। (সহীহুল বুখারী: ২১৮, ১৩৬১, ১৩৭৮, ৬০৫৫; সহিহ মুসলিম: ৫৬৪)


>>> <<<
গীবত বা পরনিন্দাঃ গীবত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন;
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلا تَجَسَّسُوا وَلا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ 
হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দুরে থাক, কারণ কোন অনুমান পাপ; আর তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না; তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশ্‌ত খেতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণই মনে কর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। (আল-হুজুরাত, ৪৯/১২)
.
একজন মুমিনের কর্তব্য অন্য মুমিনের দোষ গোপন রাখা। তার দোষ অপরের কাছে প্রকাশ না করা। বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে; আবূ বারযাহ আল-আসলামী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ، وَلَمْ يَدْخُلِ الْإِيمَانُ قَلْبَهُ، لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ، وَلَا تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ، فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعُ اللَّهُ عَوْرَتَهُ، وَمَنْ يَتَّبِعِ اللَّهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ
হে ওই সকল লোক যারা কেবল মুখে ঈমান এনেছে কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি! তোমরা মুসলিমদের গীবত করবে না ও দোষত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা তাদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন।  (আবু দাউদ ৪৮৮০; মুসনাদে আহমদ; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ আল জামে আস সগীর কিতাবে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন)
.
মু‘আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত; আমি নিজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ
إِنَّكَ إِنِ اتَّبَعْتَ عَوْرَاتِ النَّاسِ أَفْسَدْتَهُمْ، أَوْ كِدْتَ أَنْ تُفْسِدَهُمْ
তুমি যদি মানুষের গোপন দোষ জানার জন্য পিছনে লাগো তাহলে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কিংবা ক্ষতির দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিবে। (আবু দাউদ ৪৮৮৮; সহীহ)
.
গীবতের সংজ্ঞায় হাদীসে এসেছে; আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন,
أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ ‏.‏ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ قَالَ ‏إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ
তোমরা কি জানো গীবত কী? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভালো জানেন। রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমার ভাই সম্পর্কে তোমার এমন আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। বলা হলো, আমার ভাইয়ের মধ্যে যদি তা সত্যিই থাকে তাহলে সে ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? রাসূল (ﷺ) বললেন, যদি তার মধ্যে সে দোষ থাকে তবেই তো তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার মধ্যে সে দোষ না থাকে তবে তুমি তাকে অপবাদ দিলে। (সহিহ মুসলিম: ৬৪৮৭)
.
আবূ হুরাইরাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন;
إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا، وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَنَاجَشُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا
তোমরা অনুমান করা পরিহার কর, কেননা, অনুমান হচ্ছে সর্বাধিক মিথ্যা কথা। কারও দোষ তালাশ করো না, গোয়েন্দাগিরী করো না, একে অন্যকে ধোঁকা দিও না, আর পরস্পর হিংসা করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না এবং  পরস্পর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়ো না। বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে থেকো। (সহীহুল বুখারী: ৬০৬৬; মুসলিম)
.
আবদুল্লাহ ইবনু উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন;
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের বিপদ দূর করবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ গোপন করবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার দোষ গোপন করবেন। (সহীহুল বুখারী: ২৪৪২, ৬৯৫১)

>>>  <<< গীবতের শাস্তিঃ

আল-মুসতাওরিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
مَنْ أَكَلَ بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْلَةً فَإِنَّ اللَّهَ يُطْعِمُهُ مِثْلَهَا مِنْ جَهَنَّمَ، وَمَنْ كُسِيَ ثَوْبًا بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ فَإِنَّ اللَّهَ يَكْسُوهُ مِثْلَهُ مِنْ جَهَنَّمَ، وَمَنْ قَامَ بِرَجُلٍ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ، فَإِنَّ اللَّهَ يَقُومُ بِهِ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের গীবত করে এক লোকমা ভক্ষন করবে আল্লাহ তাকে এ জন্য জাহান্নাম থেকে সমপরিমাণ ভক্ষন করাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের দোষত্রুটি বর্ণনার পোশাক পরবে আল্লাহ তাকে অনুরূপ জাহান্নামের পোশাক পরাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তির (কুৎসা) রটিয়ে খ্যাতি ও প্রদর্শনীর স্তরে পৌঁছবে, মহান আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তাকে ঐ খ্যাতি ও প্রদর্শনীর জায়গাতেই (জাহান্নামে) স্থান দিবেন। (আবু দাউদ: ৪৮৮১; বুখারীর আদাবুল মুফরাদ: ২৩৯)
.
আনাস ইবনু মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ، فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ، قَالَ: هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ، وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ
মি‘রাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরী এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমন্ডলে ও বুকে আচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিবরীল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গোশত খেতো (গীবত করতো) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানতো। (আবু দাউদ ৪৭৭৮; মুসনাদে আহমদ; সহীহ)
.
মানুষের গোশ্ত খাওয়ার অর্থ হল তাদের দোষ চর্চা করা, গীবত করা, তাদের দোষ প্রচার করে সমাজে তাদের কে হেয় প্রতিপন্ন বা মানহানী করা। অপরের দোষ চর্চাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। যারা এটা করে তারা মূলতঃ নিজ মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়ার মত নিকৃষ্ট কাজ করে। এটা এমন একটি অপরাধ যা আল্লাহ নিজে ক্ষমা করবেন না। যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে সে তাকে ক্ষমা না করে। এটা ইসলামী বিধানে একটি মানবাধিকার। যারা গীবত করে, অপরের দোষ চর্চা করে সমাজে তাকে অপমান করে তারা এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। যার গীবত করা হয়েছে, যাকে অপমান করা হয়েছে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে অথবা তাকে যথাযথ ক্ষতিপুরণ দিয়ে দায়মুক্ত হতে হবে।



>>> << গীবতের ভয়াবহতাঃ
আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আরবরা সফরে গেলে একে অপরের খিদমত করত। আবুবকর ও ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা -এর সাথে একজন লোক ছিল যে তাদের খিদমত করত। তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। অতঃপর জাগ্রত হলে লক্ষ করলেন যে, সে তাদের জন্য খাবার প্রস্ত্তত করেনি (বরং ঘুমিয়ে আছে)। ফলে একজন তার অপর সাথীকে বললেন, এতো তোমাদের নবী (ﷺ)-এর ন্যায় ঘুমায়। অন্য বর্ণনায় আছে তোমাদের বাড়িতে ঘুমানোর ন্যায় ঘুমায় (অর্থাৎ অধিক ঘুমায় এমন ব্যক্তি)। অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে বললেন, তুমি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট গমন করে তাঁকে বল যে, আবুবকর ও ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা আপনাকে সালাম প্রদান করেছেন এবং আপনার নিকট তরকারী চেয়েছেন। রাসূল (ﷺ) তাকে বললেন, যাও, তাদেরকে আমার সালাম প্রদান করে বলবে যে, তারা তরকারী খেয়ে নিয়েছে। (একথা শুনে) তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট গমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা আপনার নিকট তরকারী চাইতে ওকে পাঠালাম। অথচ আপনি তাকে বলেছেন যে তারা তরকারী খেয়েছে। আমরা কি তরকারী খেয়েছি? তিনি (ﷺ) বললেন, তোমাদের ভাইয়ের গোস্ত দিয়ে। যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উভয়ের দাঁতের মধ্যে তার গোস্ত দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেন, আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি (ﷺ) বললেন, না বরং সেই তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে’ (সিলসিলা সহিহাহ: ২৬০৮)।
.
আয়িশাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক সময় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি জনৈক ব্যক্তির চালচলন নকল করে দেখালাম; তখন তিনি বললেন;
مَا يَسُرُّنِي أَنِّي حَكَيْتُ رَجُلاً وَأَنَّ لِي كَذَا وَكَذَا قَالَتْ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ صَفِيَّةَ امْرَأَةٌ وَقَالَتْ بِيَدِهَا هَكَذَا كَأَنَّهَا تَعْنِي قَصِيرَةً ‏.‏ فَقَالَ ‏ لَقَدْ مَزَجْتِ بِكَلِمَةٍ لَوْ مَزَجْتِ بِهَا مَاءَ الْبَحْرِ لَمُزِجَ
আমাকে এই পরিমাণ সম্পদ প্রদান করা হলেও কারো চালচলন নকল করা আমাকে আনন্দ দেয় না। আয়িশাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সাফিয়্যা তো বামন মহিলা লোক, এই বলে তিনি তা হাতের ইশারায় দেখালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি এমন একটি কথার দ্বারা বিদ্রুপ করেছো, তা সাগরের পানির সাথে মিশালেও তা উক্ত পানিকে দূষিত করে ফেলতো। (তিরমিযী: ২৫০২; সুনান আবূ দাউদ: ৪৮৭৫; সহীহ)
.
আবূ হুরাইরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ مَالُهُ، وَعِرْضُهُ، وَدَمُهُ حَسْبُ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ
প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের সম্পদ, সম্মান ও জীবনে হস্তক্ষেপ করা হারাম। কোনো ব্যক্তির নিকৃষ্ট প্রমাণিত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করে। (আবূ দাউদ: ৪৮৮২; তিরমিযী: ১৯২৭; সহীহ)
.
অপর মুসলিমের মান সম্মান রক্ষা করা মুমিনদের দায়িত্ব। অন্যের মান সম্মানে আঘাত করা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। অপরের গোপন দোষ প্রচার করা, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদি হারাম। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা আদালতের কাছে সংশোধনের উদ্দেশ্যে অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বা সত্য স্বাক্ষ্য প্রদান করা নিষেধ নয়।


>>>  <<<
যে সব কারণে গীবত বৈধঃ
সঠিক শরয়ী উদ্দেশ্যে গীবত বৈধ; যখন গীবত ছাড়া সে উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া সম্ভবপর হয় না। হাদীসে এসেছে;
 أَنَّ عَائِشَةَ، أَخْبَرَتْهُ‏.‏ أَنَّهُ، اسْتَأْذَنَ عَلَى النَّبِيِّ ﷺ رَجُلٌ فَقَالَ ‏"‏ ائْذَنُوا لَهُ فَبِئْسَ ابْنُ الْعَشِيرَةِ ‏"‏‏.‏ أَوْ ‏"‏ بِئْسَ أَخُوالْعَشِيرَةِ
আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর নিকট আসার অনুমতি চাইল তখন তিনি বললেনঃ তাকে অনুমতি দাও। সে তার বংশের নিকৃষ্ট সন্তান; অথবা বলেছেন; সে তার গোত্রের সর্বাপেক্ষা মন্দ লোক। (বুখারী: ৬০৩২, ৬০৫৪, ৬১৩১; মুসলিম: ৬৪৯০, ৬৪৯১; তিরমিযী: ১৯৯৬; আবূ দাউদ: ৪৭৯১)
.
এ হাদিস দ্বারা ইমাম বুখারী (রহঃ) ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী ও সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের গীবত করার বৈধতা প্রমাণ করেছেন। গীবত বৈধ-এর কারণ ৬টি, যা নিম্নরূপ:
.
১। অত্যাচার ও নির্যাতনঃ নির্যাতিত ও অত্যাচারিত ব্যক্তির পক্ষে গীবত করা বৈধ। সে শাসক, বিচারক প্রমুখ (প্রভাবশালী) ব্যক্তি; যারা অত্যাচারীকে উচিত সাজা দিয়ে ন্যায় বিচার করার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা রাখেন। তাঁদের নিকট নালিশ করবে যে, 'অমুক ব্যক্তি আমার উপর এই অত্যাচার করেছে।'
.
২। মন্দ কাজের অপসারণ এবং পাপীকে সঠিক পথ ধরানোর কাজে সাহায্য কামনা। বস্ত্ততঃ শরীয়ত বহির্ভূত কর্মকাণ্ড বন্ধ করার ব্যাপারে শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিকে গিয়ে বলবে যে, 'অমুক ব্যক্তি মন্দ কাজে লিপ্ত; সুতরাং আপনি তাকে তা থেকে বাধা দিন' ইত্যাদি। তবে এর পিছনে কেবল অন্যায় ও মন্দ কাজ থেকে বাধা দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে; অন্যথা তা হারাম হবে।
.
৩। ফতোয়া জানাঃ মুফতি বা আলেমের নিকট গিয়ে বলবে, 'আমার পিতা আমার ভাই বা আমার স্বামী অথবা অমুক ব্যক্তি এই অন্যায় অত্যাচার আমার প্রতি করেছে। তার কি কোন অধিকার আছে? তবে তা থেকে মুক্তি পাবার এবং অন্যায়ের প্রতিকার করার ও নিজ অধিকার অর্জন করার উপায় কি?' অনুরূপ আবেদন পেশ করা। এরূপ বলা প্রয়োজনে বৈধ। তবে সতর্কতামূলক ও উত্তম পন্থা হল, নাম না নিয়ে যদি বলে, 'এক ব্যক্তি বা লোক বা স্বামী এই কাজ করেছে, সে সম্পর্কে আপনি কি বলেন?' নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির নাম না নিয়ে এরূপ বললে উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবে। এ সত্ত্বেও নির্দিষ্ট করে নাম নিয়ে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা বৈধ।
.
৪। মুসলিমদেরকে মন্দ থেকে সতর্ক করা ও তাদের মঙ্গল কামনা করা। এটা কয়েক ধরণের হতে পারে। তার মধ্যে যেমনঃ
(ক) হাদিসের দোষযুক্ত রাবী ও (বিচারকার্যে) সাক্ষীর দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা। সর্বসম্মতিক্রমে এরূপ করা বৈধ; বরং প্রয়োজন বশতঃ ঐরূপ করা অত্যাবশ্যক।
.
(খ) কোন ব্যক্তির সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক জোড়ার জন্য, কোন ব্যবসায়ে অংশীদারি গ্রহণের উদ্দেশ্যে, কারো কাছে আমানত রাখার জন্য, কারো সাথে আদান-প্রদান করার মানসে অথবা কারো প্রতিবেশী হবার জন্য ইত্যাদি উদ্দেশ্যে পরামর্শ চাওয়া। আর সে ক্ষেত্রে যার নিকট পরামর্শ চাওয়া হয়, তার উচিত প্রকৃত অবস্থা খুলে বলা। বরং হিতাকাঙ্ক্ষী মনোভাব নিয়ে যত দোষ-ত্রুটি থাকবে সব ব্যক্ত করে দেবে। অনুরূপভাবে যখন কোন দ্বীনী জ্ঞান পিপাসুকে দেখবে যে, সে কোন বিদআতী ও মহাপাপী লোকের নিকট জ্ঞানার্জন করতে যাচ্ছে এবং আশংকা বোধ করবে যে, ঐ বিদআতী ও ফাসেক (মহাপাপী) দ্বারা সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাহলে সে আবশ্যিকভাবে তাকে তার অবস্থা ব্যক্ত করে তার মঙ্গল সাধন করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শর্ত হল যে, এর পিছনে তার উদ্দেশ্য যেন হিতাকাঙ্ক্ষী হয়। এ ব্যাপারটি এমন যে, সাধারণত: এতে ভুল হয়ে থাকে। কখনো বা বক্তা হিংসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐ কথা বলে। কিন্তু শয়তান তার ব্যাপারটা গোলমাল করে দেয় এবং তার মাথায় গজিয়ে দেয় যে, সে হিত উদ্দেশ্যেই ঐ কাজ করছে (অথচ বাস্তব তার বিপরীত)। এ জন্য মানুষের সাবধান থাকা উচিত।
.
(গ) যখন কোন উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসার, গভর্নর বা শাসক, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে। হয় তার অযোগ্যতার কারণে কিংবা পাপাচারী বা উদাসীন থাকার কারণে ইত্যাদি। তাহলে উক্ত ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রনেতার নিকট তার স্বরূপ তুলে ধরা একান্ত কর্তব্য। যাতে সে তার স্থানে অন্য উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ করতে পারে কিংবা কমপক্ষে তার সম্পর্কে তার জানা থাকবে এবং সেই অনুযায়ী তার সাথে আচরণ করবে এবং তার প্রতারণা থেকে মুক্ত থাকবে আর সে তাকে সংশোধন হবার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করবে, তারপর তাকে পরিবর্তন করে দেবে।
.
৫। প্রকাশ্যভাবে কেউ পাপাচার বা বিদআতে লিপ্ত হলে তার কথা বলা। যেমন প্রকাশ্যভাবে মদ্য পান করলে, লোকের ধন অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করলে, বলপূর্বক ট্যাক্স বা চাঁদা আদায় করলে, অন্যায়ভাবে যাকাত ইত্যাদি আদায় করলে, অন্যায় কাজের কর্তৃত্ব করলে, তার কেবল সেই প্রকাশ্য অন্যায়ের কথা উল্লেখ করা বৈধ। (যাতে তার অপ-নোদন সম্ভব হয়) পক্ষান্তরে তার অন্যান্য গোপন দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা বৈধ নয়। তবে যদি উল্লিখিত কারণসমূহের মধ্যে অন্য কোন কারণ থাকে। যেমন পূর্বে বর্ণনা করেছি, তাহলে তাও ব্যক্ত করা বৈধ হবে।
.
৬। প্রসিদ্ধ নাম ধরে পরিচয় দেওয়া। যখন কোন মানুষ কোন মন্দ খেতাব দ্বারা সুপরিচিত হয়ে যাবে; যেমন চোখ-ওঠা, খোঁড়া, কালা, অন্ধ, টেরা ইত্যাদি তখন সেই পরিচায়ক খেতাবগুলি উল্লেখ করা সিদ্ধ। তবে অবমাননা বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে সে সব উল্লেখ করা নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে উক্ত পদবী ছাড়া অন্য শব্দ বা নাম দ্বারা যদি পরিচয় দান সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই সব চাইতে উত্তম।
.
এই হল ছয়টি কারণ, যার ভিত্তিতে গীবত করা বৈধ আর এর অধিকাংশ সর্ববাদিসম্মত। (রিয়াদুস সালেহিন: ১৫৩৯)



Post a Comment

0 Comments