Header Ads Widget

Responsive Advertisement

অন্তর-বিধ্বংসী তর্ক-বির্তক, ঝগড়া-বিবাদ

অন্তর-বিধ্বংসী তর্ক-বির্তক, ঝগড়া-বিবাদঃ

ঝগড়া-বিবাদ এমন একটি কঠিন ব্যাধি ও মহা-মুসিবত, যা মানুষের অন্তরকে করে কঠিন আর জীবনকে করে ক্ষতি ও হুমকির সম্মুখীন। উলামায়ে কিরামগণ এর ক্ষতির দিক বিবেচনার বিষয়টি সম্পর্কে উম্মতদের খুব সতর্ক করেছেন এবং এ নিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি করেন। এটি এমন একটি দুশ্চরিত্র যাকে সলফে সালেহীনরা খুব ঘৃণা করত এবং এ থেকে অনেক দূরে থাকত। ইবরাহীমে নখয়ী (রহ.) বলেন; সালফে সালেহীন ঝগড়া-বিবাদকে অধিক ঘৃণা করত।
.
আরবীতে جِدَال (জিদাল): এর অর্থ হলো, ঝগড়া করা ও কথা কাটাকাটি করা। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করা নিজের কথা সত্য প্রমাণ করা জন্য। এটি হলো, প্রতিপক্ষের সাথে ঝগড়া করা। আল্লামা যাজ্জাজ (রহ.) বলেন, জিদাল “উচ্চ পর্যায়ের ঝগড়া ও বিতর্ক। আরবীতে আরেকটি শব্দ হলো مِرَاء (মিরা’): অনেকে বলেন, উভয় শব্দের অর্থ একই। তবে মিরা’ হলো নিন্দনীয় বিতর্ক। কারণ, এটি হলো, হক প্রকাশ পাওয়ার পরও তা নিয়ে অনর্থক বিতর্ক করা। তবে জিদাল এ রকম নয়।
.
অধিকাংশ মানুষ হক জানে না, হক মানে না। হক গ্রহণে উদারতা প্রদর্শন করে না, বরং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। হক মানতে তর্ক-বিতর্ক করে। এই শ্রেণীর তর্কপ্রিয় মানুষদের কথা মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবের একাধিক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন;
وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ ۚ وَيُجَادِلُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِالْبَاطِلِ لِيُدْحِضُوا بِهِ الْحَقَّ ۖ وَاتَّخَذُوا آيَاتِي وَمَا أُنْذِرُوا هُزُوًا
আর আমি শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই রাসূলদেরকে পাঠিয়ে থাকি কিন্তু যারা কুফরী করেছে তারা বাতিল দ্বারা তর্ক করে, যাতে তার মাধ্যমে সত্যকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। আর তারা আমার নিদর্শনাবলী ও যা দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, সেসবকে বিদ্রুপের বিষয়রূপে গ্রহণ করে থাকে। (আল-কাহ্‌ফ, ১৮/৫৪)

অজ্ঞতার কারণে তর্কে লিপ্ত হয়ঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلا هُدًى وَلا كِتَابٍ مُنِيرٍ ثَانِيَ عِطْفِهِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَنُذِيقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَذَابَ الْحَرِيقِ ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ يَدَاكَ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ
আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে; তাদের না আছে জ্ঞান, না আছে পথনির্দেশ, আর না আছে দীপ্তিমান কিতাব। সে বিতন্ডা করে অহংকারে ঘাড় বাঁকিয়ে আল্লাহর পথ হতে ভ্রষ্ট করার জন্য, তার জন্য লাঞ্ছনা আছে দুনিয়াতে এবং কিয়ামতের দিবসে আমি তাকে আস্বাদন করাব দহণ যন্ত্রণা। ‘এটা তোমার কৃতকর্মেরই ফল, আর আল্লাহ বান্দাদের প্রতি বিন্দুমাত্রও যুলুমকারী নন।’ (আল-হাজ্জ, ২২/৮-১০)
.
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلا هُدًى وَلا كِتَابٍ مُنِيرٍ وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطَانُ يَدْعُوهُمْ إِلَى عَذَابِ السَّعِيرِ
আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ কোন জ্ঞান, কোন পথ-নির্দেশ, কিংবা কোন দীপ্তিমান কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে। আর তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর।’ তখন তারা বলে, ‘বরং আমরা আমাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব।’ শয়তান যদি তাদেরকে কঠোর শাস্তির দিকে ডাকে, তবুও কি? (লুকমান, ৩১/২০-২১)
.
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَرِيدٍ كُتِبَ عَلَيْهِ أَنَّهُ مَنْ تَوَلاهُ فَأَنَّهُ يُضِلُّهُ وَيَهْدِيهِ إِلَى عَذَابِ السَّعِيرِ
মানুষের মধ্যে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে এবং সে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের অনুসরণ করে। তার সম্বন্ধে লিখে দেয়া হয়েছে যে, যে কেউ তাকে অভিভাবক বানাবে সে তাকে অবশ্যই পথভ্রষ্ট করবে এবং তাকে পরিচালিত করবে প্রজ্জ্বলিত আগুনের শাস্তির দিকে। (আল-হাজ্জ, ২২/৩-৪)
.
অন্তরে আছে অহংকার তাই তর্কে লিপ্ত হয়ঃ
إِنَّ الَّذِينَ يُجَادِلُونَ فِي آيَاتِ اللَّهِ بِغَيْرِ سُلْطَانٍ أَتَاهُمْ إِنْ فِي صُدُورِهِمْ إِلا كِبْرٌ مَا هُمْ بِبَالِغِيهِ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
নিশ্চয় যারা নিজেদের নিকট আগত কোন দলীল ছাড়াই আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়, ওদের অন্তরে আছে কেবল অহংকার যা সফল হওয়ার নয়। অতএব তুমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর; নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (আল-মুমিন, ৪০/৫৬)

الَّذِينَ يُجَادِلُونَ فِي آيَاتِ اللَّهِ بِغَيْرِ سُلْطَانٍ أَتَاهُمْ ۖ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ وَعِنْدَ الَّذِينَ آمَنُوا ۚ كَذَٰلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ قَلْبِ مُتَكَبِّرٍ جَبَّارٍ
যারা নিজেদের নিকট আগত কোন দলীল-প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয় তাদের এ কাজ আল্লাহ এবং মুমিনদের নিকট অতিশয় অসন্তোষের বিষয়। এইভাবে আল্লাহ প্রত্যেক উদ্ধত ও স্বৈরাচারী ব্যক্তির অন্তরকে মোহর করে দেন। (আল-মু'মিন, ৪০/৩৫)
.
অসার তর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণে নূহের সম্প্রদায়কে আযাব দেয়া হয়েছিলঃ
كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوحٍ وَالْأَحْزَابُ مِنْ بَعْدِهِمْ ۖ وَهَمَّتْ كُلُّ أُمَّةٍ بِرَسُولِهِمْ لِيَأْخُذُوهُ ۖ وَجَادَلُوا بِالْبَاطِلِ لِيُدْحِضُوا بِهِ الْحَقَّ فَأَخَذْتُهُمْ ۖ فَكَيْفَ كَانَ عِقَابِ
তাদের আগে নূহের সম্প্রদায় এবং তাদের পরে অনেক দলও মিথ্যারোপ করেছিল। প্রত্যেক উম্মতই নিজ নিজ রাসূলকে পাকড়াও করার সংকল্প করেছিল এবং তারা অসার তর্কে লিপ্ত হয়েছিল, তা দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য। ফলে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। সুতরাং কত কঠোর ছিল আমার আযাব! (আল-মু’মিন, ৪০/৫)

মুসলিমদের পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করাঃ
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া করবে না, করলে, তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (আল-আনফাল, ৮/৪৬)
.
পরস্পর বিরোধিতার ফলে অন্তরগুলি বিভক্ত হয়ে যায়ঃ রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
وَلاَ تَخْتَلِفُوا فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ
তোমরা পরস্পরের বিরোধিতা করো না; তাহলে তোমাদের অন্তরগুলি বিভক্ত হয়ে যাবে। (সহিহ মুসলিম: ৮৫৮ সূনান আত-তিরমিজী: ২২৬)
.
অন্যত্র রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
وَلاَ تَخْتَلِفُوا، فَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ اخْتَلَفُوا فَهَلَكُوا
তোমরা মতবিরোধ বা পরস্পরের বিরোধিতা করো না; কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ মতবিরোধের কারণেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। (সহীহুল বুখারী: ৩৪৭৬, ২৪১০)
.
মহান আল্লাহ এই উম্মতকে আমভাবে তর্ক করতে অনুমতি দেননি। বিধর্মীদের সাথে তর্ক করতে হলে সৌজন্যের সাথে করতে হবে। আল্লাহ বলেন;
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ ۖ وَقُولُوا آمَنَّا بِالَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَأُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَٰهُنَا وَإِلَٰهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করবে না। তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে যুলুম করেছে। আর তোমরা বল, ‘আমাদের প্রতি এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে, তাতে আমরা ঈমান এনেছি। আর আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো এক। আর আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’। (আল-আনকাবুত, ২৯/৪৬)
.
কিতাবীদের সাথে উত্তম পন্থায় তর্ক-বির্তক কর। উদাহরণত: কঠোর কথাবার্তার জওয়াব নম্র ভাষায়, ক্রোধের জওয়াব সহনশীলতার সাথে এবং মূর্খতাসূলভ হট্রগোলের জওয়াব গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাবার্তার মাধ্যমে দাও। বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা উপযুক্ত যুক্তি-প্রমাণ সহকারে, ভদ্র ও শালীন ভাষায় এবং বুঝবার ও বুঝাবার ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে করতে হবে। এর ফলে যার সাথে আলোচনা হয় তার চিন্তার সংশোধন হবে। প্রচারকের চিন্তা করা উচিত, তিনি শ্রোতার হৃদয় দুয়ার উম্মুক্ত করে সত্যকথা তার মধ্যে বসিয়ে দেবেন এবং তাকে সঠিক পথে আনবেন। কিতাবীদের সাথে বিতর্ক-আলোচনা করার ব্যাপারে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা কেবলমাত্র বিশেষভাবে কিতাবীদের জন্য নয়। মুশরিকদের সাথেও তর্কের ব্যাপারে অনুরূপ নির্দেশ আছে। বরং দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে এটি সাধারণ নির্দেশ।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন;
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে দাওয়াত দাও হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে বির্তক কর সদ্ভাবে; নিশ্চয় তোমার রব, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে বেশী জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি খুব ভালভাবেই জানেন। (আন্-নাহল, ১৬/১২৫)
.
উক্ত আয়াতে দাওয়াত দেয়ার মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, তা হবে হিকমত, সদুপদেশ ও নম্রতার উপর ভিত্তিশীল এবং আলোচনার সময় সদ্ভাব বজায় রাখা, কঠোরতা পরিহার করা ও নম্রতার পথ অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।

আল্লাহর কিতাব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা মোটেও বৈধ নয়। তিনি বলেছেন;
وَلَقَدْ صَرَّفْنَا فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ لِلنَّاسِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ ۚ وَكَانَ الْإِنْسَانُ أَكْثَرَ شَيْءٍ جَدَلًا
আর অবশ্যই আমি মানুষের জন্য এ কুরআনে সব ধরনের উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। আর মানুষ সবচেয়ে বেশি তর্কপ্রিয়। (আল-কাহ্‌ফ, ১৮/৫৪)
আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
الْمِرَاءُ فِي الْقُرْآنِ كُفْرٌ
কুরআন নিয়ে ঝগড়া করা কুফরী। (আবু দাউদ: ৪৬০৩)
.
কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা তাফসীর বিষয়ে বিতর্ক করাকে জিদাল বা ঝগড়া বলা হয় না। যেমন, কোনো ব্যক্তি বলল; কুরআনের এ আয়াতের অর্থ এটি? নাকি এটি? তারপর একাধিক অর্থ হতে কোনো একটিকে প্রাধান্য দিল। এ ধরনের বিতর্ককে জিদাল বা ঝগড়া বলা হবে না, বরং এ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণীর মর্মার্থ জানার জন্য পর্যালোচনা করা। মোটকথা, কুরআন বিষয়ে বিবাদ করাকে কুফুর বলে আখ্যায়িত করা তখন হবে, যখন কুরআনকে সন্দেহ, সংশয় ও অস্বীকার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
.
একদা কুরআনী কোন বিষয় নিয়ে কিছু সাহাবাকে তর্ক করতে দেখে নবী ﷺ বললেন;
مَهْلًا يَا قَوْمِ بِهَذَا أُهْلِكَتْ الْأُمَمُ مِنْ قَبْلِكُمْ بِاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ وَضَرْبِهِمْ الْكُتُبَ بَعْضَهَا بِبَعْضٍ إِنَّ الْقُرْآنَ لَمْ يَنْزِلْ يُكَذِّبُ بَعْضُهُ بَعْضًا بَلْ يُصَدِّقُ بَعْضُهُ بَعْضًا فَمَا عَرَفْتُمْ مِنْهُ فَاعْمَلُوا بِهِ وَمَا جَهِلْتُمْ مِنْهُ فَرُدُّوهُ إِلَى عَالِمِهِ
থামো হে লোক সকল! নবীদের ব্যাপারে মতভেদ এবং কিতাবের একাংশকে অন্য অংশের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি ক’রে তোমাদের পূর্বের বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে। কুরআন এভাবে অবতীর্ণ হয়নি যে, তার একাংশ অন্য অংশকে মিথ্যায়ন করবে। বরং তার একাংশ অন্য অংশকে সত্যায়ন করে। সুতরাং যা তোমরা বুঝতে পার, তার উপর আমল কর এবং যা বুঝতে পার না, তা তার জ্ঞানীর দিকে ফিরিয়ে দাও। (আহমাদ ৬৭০২, শারহুল আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়্যাহ ১/২১৮)
.
মুমিন হয় চরিত্রবান উদার, তার ঈমান হয় অকপট প্রত্যয় ও সরল বিশ্বাস, মুসলিমের ইসলাম হয় দ্বিধাহীন আত্মসমর্পণ ও নিষ্ঠার সাথে আনুগত্য। তার তর্কের প্রয়োজন হয় না, তর্কে জড়ায়ও না। যেহেতু সে বিতর্ক করতে আদিষ্ট নয়, সে আদিষ্ট প্রচার করতে পৌছে দিতে। আসলে তর্ক করে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী মুসলিম নামধারী কিছু মুনাফিক অথবা কাফেরদের ছত্র ছায়ায় বসববাসকারী কিছু ক্রীতমস্তিষ্কের মুর্তাদ। তারাই কুরআন নিয়ে নানা সন্দিহান ও বিতর্ক সৃষ্টি করে ভিতর থেকে ইসলামকে দুর্বল করার অপচেষ্টা করে। আর সত্য কথা এই যে, তারা তর্কে সফলতা লাভ করে।
.
আব্দুর রহমান বিন জুবাইর বিন নুফাইর, তিনি তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা নুফাইর থেকে বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لَا تُجَادِلُوا بِالْقُرْآنِ وَلَا تُكَذِّبُوا كِتَابَ اللَّهِ بَعْضَهُ بِبَعْضٍ فَوَاللَّهِ إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُجَادِلُ بِالْقُرْآنِ فَيَغْلِبُ وَإِنَ الْمُنَافِقَ لِيُجَادِلَ بِالْقُرْآنِ فَيَغْلِبُ
তোমরা কুরআন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করো না এবং আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ দ্বারা কিছু অংশকে মিথ্যাজ্ঞান করো না। আল্লাহর কসম! মু’মিন কুরআন নিয়ে বিতর্ক করলে পরাজিত হবে এবং মুনাফিক কুরআন নিয়ে বিতর্ক করলে বিজয়ী হবে। (ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ৩৪৪৭)
.
যিয়াদ ইবনু হুদায়র (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি বলতে পারো, ইসলাম ধ্বংস করবে কোন জিনিসে? আমি বললাম, আমি বলতে পারি না; তখন তিনি বললেন;
يَهْدِمُه زَلَّةُ الْعَالِمِ وَجِدَالُ الْمُنَافِقِ بِالْكِتَابِ وَحُكْمُ الْأَئِمَّةِ الْمُضِلِّينَ
১) আলেমদের পদস্খলন, আর ২) আল্লাহর কিতাব (কুরআন) নিয়ে মুনাফিক্বদের ঝগড়া-বিবাদ বা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া এবং ৩) পথভ্রষ্ট শাসকদের শাসন। (মিশকাতুল মাসাবীহ: ২৬৯; সুনানে দারিমী ২১৪; সহীহ)

প্রকৃত আলেম তর্কে জড়ান নাঃ তর্ক করার জন্য ইলম শিক্ষা করাও বৈধ নয়। ইবনু উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন;
مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ ، أَوْ لِيُبَاهِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ  ، أَوْ لِيَصْرِفَ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ فَهُوَ فِي النَّارِ
যে ব্যক্তি মূর্খ লোকদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা উলামাদের উপর বাহাদুরি প্রকাশের জন্য অথবা তার প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জ্ঞানার্জন করে, সে জাহান্নামী। (ইবনে মাজাহ: ২৫৩; তিরমিযী: ২৬৫৫; তাহক্বীক্ব আলবানী: হাসান)
.
আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
مَنْ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ لِيُبَاهِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ وَيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ وَيَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ جَهَنَّمَ
যে ব্যাক্তি আলিমদের উপর বাহাদুরি জাহির করার জন্য, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং নিজের দিকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন। (ইবনে মাজাহ ২৬০; হাসান)
.
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
لاَ تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ وَلاَ لِتُمَارُوا بِهِ السُّفَهَاءَ وَلاَ تَخَيَّرُوا بِهِ الْمَجَالِسَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَالنَّارُ النَّارُ
তোমরা আলিমদের উপর বাহাদুরী প্রকাশের জন্য, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং জনসভার উপর বড়ত্ব প্রকাশ করার জন্য ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করো না; যে ব্যাক্তি এরূপ করবে, তার জন্য রয়েছে আগুন আর আগুন। (ইবনে মাজাহ ২৫৪; সহীহ তারগীব: ১০২; তাহক্বীক্ব আলবানীঃ সহীহ)
.
হুযাইফাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি;
لاَ تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِتُمَارُوا بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ لِتَصْرِفُوا وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْكُمْ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَهُوَ فِي النَّارِ
তোমরা আলিমগণের উপর বাহাদুরি জাহির করার জন্য অথবা নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা সাধারণ মানুষের মনোযোগ তোমাদের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য জ্ঞানার্জন করো না; যে তা করবে সে জাহান্নামী। (ইবনে মাজাহ ২৫৯; হাসান)
.
তর্কে অনেক সময় হককে বাতিল প্রতিপন্ন করা হয় আর সে ক্ষেত্রে ভ্রষ্টতা ছাড়া কিছু লাভ হয় না। সত্য জানার পরেও শুধু প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা ব্যক্তি, দল, মত, বংশ ইত্যাদির স্বার্থে অন্যায় জেনেও তার সমর্থনে তর্ক-বিতর্ক গোমরাহীর একটি কারণ। আবু উমারা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;
مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلَّا أُوتُوا الْجَدَلَ ثُمَّ تَلَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذِهِ الْآيَةَ {مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ
কোন জাতি হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার পরে গোমরাহ হয় না যতক্ষণ না তারা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়। অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আয়াত পাঠ করলেনঃ
مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا - بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ
“তারা তোমার সামনে যে উদাহরণ পেশ করে, তা কেবল বিতর্কের জন্যই করে। বস্তুতঃ তারা হল এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়।” (আয-যুখরুফ, ৪৩/৫৮) (তিরমিযী: ৩২৫৩, ইবনে মাজাহ: ৪৮, সহীহ তারগীব- হাসান, আলবানী)।

তর্কপ্রিয় মানুষ মহান প্রতিপালকের নিকট অপছন্দনীয়ঃ বরং সে তাঁর নিকট সবচেয়ে ঘৃণ্য। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللهِ الأَلَدُّ الْخَصِمُ
আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ হল কঠিন ঝগড়াটে ও হুজ্জতকারী ব্যক্তি। (বুখারী ২৪৫৭, মুসলিম ৬৯৫১)
.
হকপন্থী ও সত্যাশ্রয়ী নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তর্ক করা উচিত নয়। যে তর্ক করে না, সে চরিত্রবান। তার জন্য রয়েছে জান্নাত। আবূ উমামাহ বাহেলী রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন; রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا وَبِبَيْتٍ فِي أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ
আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের শেষ সীমায় একটি ঘর দেওয়ার জন্য জামিন হচ্ছি, যে সত্যাশ্রয়ী হওয়া সত্ত্বেও তর্ক-বির্তক বর্জন করে। সেই ব্যক্তির জন্য আমি জান্নাতের মধ্যস্থলে একটি ঘরের জামিন হচ্ছি, যে উপহাসছলেও মিথ্যা বলা বর্জন করে। আর সেই ব্যক্তির জন্য আমি জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটি ঘরের জামিন হচ্ছি, যার চরিত্র উত্তম। (আবু দাঊদ: ৪৮০০)
.
আর বাতিলপন্থী হয়ে জেনেশুনে তর্ক করা অবশ্যই চরিত্র্রবান মানুষের কর্ম নয়। এমন লোক মহান প্রতিপালকের ক্রোধভাজন। আব্দুল্লাহ বিন উমার রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَمَنْ خَاصَمَ فِى بَاطِلٍ وَهُوَ يَعْلَمُهُ لَمْ يَزَلْ فِى سَخَطِ اللهِ حَتّٰـى يَنْزِعَ عَنْهُ
যে ব্যক্তি জেনেশুনে কোন বাতিল (অন্যায়) বিষয়ে তর্কাতর্কি করে, সে ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর রোষে থাকে; যতক্ষণ পর্যন্ত সে তা বর্জন না করে।’’ (আবূ দাউদ ৩৫৯৭, হাকেম ২/২৭, ত্বাবারানী, বাইহাকী, সহীহুল জামে’ ৬১৯৬)
.
হজ্বের সময় ঝগড়া-বিবাদ নিষিদ্ধঃ
الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ ۚ فَمَنْ فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللَّهُ ۗ وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ ۚ وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ
হজ্ব হয় নির্দিষ্ট মাসগুলোতে। অতএব যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ্ব করা স্থির করে সে হজ্বের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ করবে না। আর তোমরা উত্তম কাজ থেকে যা-ই কর, আল্লাহ তা জানেন আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। আর হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ!, তোমরাই তাকওয়া অবলম্বন কর। (আল-বাকারাহ, ২/১৯৭)
.
(জিদাল) جِدَال বা ঝগড়া-বিবাদ সর্বক্ষেত্রেই পাপও নিষিদ্ধ, কিন্তু এহরামের অবস্থায় এর পাপ গুরুতর। পবিত্র দিনসমূহে এবং পবিত্র স্থানে যেখানে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাতে ব্যস্ত, এমতাবস্থায় ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি অত্যন্ত অন্যায় ও চরমতম নাফরমানীর কাজ।

উপেক্ষা করে চলাঃ চরিত্রবান নর-নারী নিন্দুকের নিন্দা ও সমালোচকের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে। যখন সে জানে যে, সে হক পথে প্রতিষ্ঠিত, তখন কোন রটনায় সে কান দেয় না। অটল ও অবিচল থেকে নিজ হক পথে চলমান থাকে। যেহেতু এ হল মহান স্রষ্টার নির্দেশ। সমাজে বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ বসবাস করে। সেখানে থাকে কাফের, মুনাফিক ও অজ্ঞ-মূর্খ। এদের প্রত্যেকের সাথে একই আচারণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; উপেক্ষা কর, তর্কে যেয়ো না, সংঘাতে যেও না, মনমরা হও না, কষ্ট নিও না। মুশরিকদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন;
اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ ۖ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
তোমার রবের কাছ থেকে তোমার প্রতি যা ওহী হয়েছে তুমি তারই অনুসরণ কর। তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই আর মুশরিকদের উপেক্ষা করে চল। (আল আন‘আম, ৬/১০৬)
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ তা প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর। (আল-হিজর, ১৫/৯৪)
.
পার্থিব বিশ্বাসীদের ব্যাপারেও মহান আল্লাহ বলেন;
فَأَعْرِضْ عَنْ مَنْ تَوَلَّىٰ عَنْ ذِكْرِنَا وَلَمْ يُرِدْ إِلَّا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا ذَٰلِكَ مَبْلَغُهُمْ مِنَ الْعِلْمِ
অতএব তুমি তাকে উপেক্ষা করে চল, যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হয় এবং কেবল দুনিয়ার জীবনই কামনা করে। এটাই তাদের জ্ঞানের শেষ সীমা। (আন-নাজ্‌ম, ৫৩/২৯-৩০)
তারা যত বড়ই শিক্ষিত হোক, যত বড়ই বিজ্ঞানী হোক, তাদের শিক্ষা ও জ্ঞান কেবল পার্থিব জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন;
يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ
তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিক সম্বন্ধে অবগত,, আর তারা আখিরাত সম্বন্ধে গাফিল। (আর-রূম, ৩০/৭)
.
মুনাফিকদের ব্যাপারেও আল্লাহ বলেছেন;
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُلْ لَهُمْ فِي أَنْفُسِهِمْ قَوْلًا بَلِيغًا
এরাই তারা, যাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ তা জানেন। কাজেই তুমি তাদেরকে উপেক্ষা কর, এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও আর তাদেরকে তাদের মর্মস্পর্শ করে এমন কথা বল। (আন-নিসা, ৪/৬৩)
.
অজ্ঞ ও জাহেল লোকেরাও অনেক কিছু বলে থাকে। নবী ও তাঁর ওয়ারেসগণকে তাও উপেক্ষা করে চলতে হয়। মহান আল্লাহর নির্দেশ হল;
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ
তুমি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন কর এবং সৎ কাজের আদেশ দাও আর মূর্খদের এড়িয়ে চল। (আল-আরাফ, ৭/১৯৯)

তর্ক না করার ব্যাপারে জ্ঞানীদের কিছু উপদেশ হলঃ-
১) শায়খ ইবনে উছাইমীন বলেছেন, যে মানুষ বেশী বেশী বিতর্কে জড়ায়, সে ইলমের বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। কেননা বিতর্ককারী অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের মতবাদকে বিজয়ী করতে সচেষ্ট থাকে। আর এভাবে ইলমের বরকত থেকে সে বঞ্চিত হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি হক অনুসন্ধান করে, তার সামনে হকের রাস্তা সহজ ও নিকটবর্তী। খুব বেশী তর্ক-বিতর্কের দরকার পড়ে না।
.
২) আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন; একজন কুরআন ওয়ালা বা জ্ঞানীর জন্য যে ঝগড়া করে তার সাথে ঝগড়া করা, অনুরূপভাবে কোনো মূর্খের সাথে তর্ক করা কোনো ক্রমেই উচিৎ নয়। তার জন্য উচিৎ হলো, ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করা।
.
৩) ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, শরীয়তে ঐ বিতর্ককে তিরস্কার করা হয়েছে যা ইলম ছাড়া অন্যায়ভাবে করা হয় অথবা সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও করা হয়।
.
৪) তর্ক কর না, কারণ তর্কে জেতা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বরং তর্কে না জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ।
৫) কোন বাকপটু ও নির্বোধের সাথে তর্ক কর না, কারণ বাকপটু তোমাকে কথায় পরাজিত করবে আর নির্বোধ তোমাকে কষ্ট দিবে।
৬) আহমকের সঙ্গে তর্ক কর না, কারণ লোকে তোমাদের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে ভুল করতে পারে।
৭) আহমক যখন কথা বলে তখন তুমি তার কথার জবাব দিয়ো না। যেহেতু তার কথার জবাব দেওয়া অপেক্ষা চুপ থাকা উত্তম।
৮) আহমকের কথার উত্তর না দেয়াই তার উত্তর। আল্লাহ বলেন;
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
আর যখন তারা অসার বাক্য শুনে তখন তা উপেক্ষা করে চলে এবং বলে, ‘আমাদের আমল আমাদের জন্য আর তোমাদের আমল তোমাদের জন্য; সালাম তোমাদের। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়াতে চাই না’। (আল-কাসাস ২৮/৫৫)
.
৯) ছোট খাট বিষয়ে বিতর্ক করলে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। কারণ, আমাদের মাঝে এমন অনেক লোক আছে যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চেয়ে ছোট-খাট বিষয়গুলো সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখে।
১০) জ্ঞানী আগে চিন্তা করে পরে কথা বলে আর নির্বোধ আগে কথা বলে পরে চিন্তা করে।
১১) ভূল করা দোষের নয় বরং ভূলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা দোষণীয়।
১২) যার ভুল হয় সে মানুষ আর যে ভুলের উপর স্থির থাকে সে শয়তান।
.
পরিশেষে বলবো, তর্কে কোন লাভ নেই। তর্কে হককে বাতিল প্রতিপন্ন করা হতে পারে। তর্কে দলীল হারিয়ে প্রতিপক্ষ গালাগালি ও অসভ্য ভাষা প্রয়োগ করে। পরে বাড়াবাড়ি হয়ে তা মারামারিতে পৌঁছে যেতে পারে। যেহেতু তর্কে নিজের ঘোলকে কেউ টক বলে না। তাই কেউ হক না মানলে আপনি তার সাথে তর্ক করবেন না। আপনার কাজ হক পৌঁছে দেওয়া। হিদায়াতের মালিক আল্লাহ।
.
সংসার-ধর্মেও আপনি তর্ক বর্জন করুন। কথায়-কথায় তর্ক-বির্তক, ঝগড়া-বিবাদ করলে মানুষ আপনার কাছ হতে দুরে সরে যাবে। তর্কাতর্কি ভালবাসা মলিন হতে থাকে। আপনি অপরের কাছে অপ্রিয় ও অবঞ্ছিত হয়ে যাবেন। কারো কথা অপছন্দ হলে অথবা অযৌক্তিক লাগলে এবং মেনে নিতে না পারলে তর্ক-বির্তক ও ঝগড়া-বিবাদ বর্জন করুন। তাতে আপনি শান্তি পাবেন ও স্বস্তি পাবেন। নচেৎ এমনও হতে পারে, বিবাদ এক সময় নিয়ে যাবে গালাগালিতে। অতঃপর শেষ হবে মারামারিতে।


Post a Comment

0 Comments