কুরআনের ছোঁয়ায় বদলে যাক এ জীবন।
আবদুল্লাহিল হাদী বিন আবদুল জলীল
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা: আল কুরআন মহান আল্লাহর বাণীর অপূর্ব সমাহার বিস্ময়কর এক গ্রন্থের নাম। আল কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সংরক্ষিত এক সংবিধান। এই কুরআন যেমন সমগ্র মানবজাতির মানসিক সংশয়, সন্দেহ, অস্পষ্টতা, কুপ্রবৃত্তি, লোভ-লালসা নামক নানারকম রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের অব্যর্থ মহৌষধ ঠিক তেমনি দৈহিক রোগ-ব্যাধি, বেদনা, কষ্ট-ক্লেশ এবং জীবন চলার পথের সকল অন্ধকার বিদূরিত করার এক অনবদ্য নির্দেশিকা। এই কুরআন হল,
সত্য-মিথ্যা এবং বৈধ-অবৈধের সীমা-রেখা নির্ধারণের এক সুউচ্চ মাইল ফলক, সুখ সমৃদ্ধ জীবনের বিশ্বস্ত ঠিকানা এবং পশ্চাদপদতা, দুর্ভাগ্য ও হতাশার গ্লানি থেকে মুক্তির অনুপম গাইড লাইন।
বিশ্ববাসীর প্রতি আল কুরআনের চ্যালেঞ্জ:
আল কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত বিশ্বের এক চিরন্তন বিস্ময়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমগ্র মানব ও দানব জাতির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন-কুরআনের মত আরেকটি গ্রন্থ তারা সবাই মিলে রচনা করুক তো। কিন্তু কাল প্রবাহে সবাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
ﻗُﻞْ ﻟَﺌِﻦِ ﺍﺟْﺘَﻤَﻌَﺖ ﺍﻟْﺄِﻧْﺲُ ﻭَﺍﻟْﺠِﻦُّ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻥْ ﻳَﺄْﺗُﻮﺍ ﺑِﻤِﺜْﻞِ ﻫَﺬَﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻻ ﻳَﺄْﺗُﻮﻥَ ﺑِﻤِﺜْﻠِﻪِ ﻭَﻟَﻮْ ﻛَﺎﻥَ ﺑَﻌْﻀُﻬُﻢْ ﻟِﺒَﻌْﺾٍ ﻇَﻬِﻴﺮﺍً
“বলুন, যদি মানব ও জিন সকলে কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য একত্রিত হয়, এবং তারা পরস্পরে সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা এর অনুরূপ রচনা করতে পারবে না।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৮৮)
আবার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে, পুরো গ্রন্থ নয়; কুরআনের মত দশটি সূরা তারা রচনা করুক তো। কিন্তু তাতেও সবাই ব্যর্থ হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
ﺃَﻡْ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﺍﻓْﺘَﺮَﺍﻩُ ﻗُﻞْ ﻓَﺄْﺗُﻮﺍ ﺑِﻌَﺸْﺮِ ﺳُﻮَﺭٍ ﻣِﺜْﻠِﻪِ ﻣُﻔْﺘَﺮَﻳَﺎﺕٍ ﻭَﺍﺩْﻋُﻮﺍ ﻣَﻦِ ﺍﺳْﺘَﻄَﻌْﺘُﻢْ ﻣِﻦْ ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺻَﺎﺩِﻗِﻴﻦَ
“তারা কি বলে কুরআন সে (অর্থাৎ নবী মোহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে তৈরি করেছে? আপনি বলে দিন, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আস। আর আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো ডেকে নাও। যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে।” (সূরা হুদ: ১৩)
আবারো চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করা হয়েছে, মাত্র একটি সূরা তারা রচনা করুক। কিন্তু এতেও তারা ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছে । আল্লাহ তায়ালা বলেন:
ﻭَﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻓِﻲ ﺭَﻳْﺐٍ ﻣِﻤَّﺎ ﻧَﺰَّﻟْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﻋَﺒْﺪِﻧَﺎ ﻓَﺄْﺗُﻮﺍ ﺑِﺴُﻮﺭَﺓٍ ﻣِّﻦْ ﻣِﺜْﻠِﻪِ ﻭَﺍﺩْﻋُﻮﺍ ﺷُﻬَﺪَﺍﺀَﻛُﻢْ ﻣِﻦْ ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺻَﺎﺩِﻗِﻴﻦ
“আমি আমার বান্দার নিকট যা অবতীর্ণ করেছি সে ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে তবে এর মত একটিমাত্র সূরা রচনা করে নিয়ে আস তো। এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহায্যকারীদেরকেও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।” (সূরা বাকারাঃ ২৩)
আল কুরআন বরকতময় এক গ্রন্থের নাম:
যাবতীয় কল্যাণ, সর্বপ্রকার জ্ঞান-গরিমা, প্রজ্ঞা ও রহস্যের আধার হল আল কুরআন। একে অনুসরণ করেই দুনিয়া ও আখেরাতে পাওয়া যায় সুখের সন্ধান, মেলে সঠিক পথের দিশা। পক্ষান্তরে কুরআন থেকে দূরে থাকলে, কুরআনকে একমাত্র সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করলে নানারকম দুর্ভাগ্য, দুশ্চিন্তা, হতাশা, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি মানব জীবনকে ঘিরে ফেলে, প্রতি পদে নেমে আসে গহীন অন্ধকার।
কুরআন দেয় নিজের পরিচয়:
কুরআন সকল রোগের প্রতিষেধক এবং বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপঃ আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ ﻭَﻧُﻨَﺰِّﻝُ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻣَﺎ ﻫُﻮَ ﺷِﻔَﺎﺀٌ ﻭَﺭَﺣْﻤَﺔٌ ﻟِﻠْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦ “আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের প্রতিষেধক এবং মুমিনদের জন্য রহমত।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৮২)
সত্যের দিশারী এবং আলোকবর্তীকাঃ আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “এই কুরআন দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা যারা তাঁর সন্তষ্টি কামনা করে তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে প্রদান করেন সরল-সোজা পথের দিশা।” (সূরা মায়িদাহঃ ১৬)
সত্য পথের পথিকদের মহাপুরস্কারের শুভ সংবাদ দেয় কুরআনঃ ইরশাদ হচ্ছেঃ “আল্লাহ এ(জান্নাতেরই) শুভ সংবাদ প্রদান করে সে সব বান্দাকে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে। বলুন, আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না। শুধু চাই আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্য। কেউ উত্তম কাজ করলে আমি তার সোয়াব বৃদ্ধি করে দেই। আল্লাহ তো ক্ষমাকারী এবং গুণগ্রাহী।” (সূরা শূরাঃ ২৩)
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার: আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন:
ﺫَﻟِﻚَ ﻧَﺘْﻠُﻮﻩُ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺂﻳﺎﺕِ ﻭَﺍﻟﺬِّﻛْﺮِ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴﻢ
“আমি তোমাদেরকে এসমস্ত আয়াত এবং বিজ্ঞানময় উপদেশ বানী পড়ে শুনাই। (সূরা আলে ইমরান: ৫৮)
আত্বা ও জীবনের স্পন্দনঃ আল্লাহ বলেনঃ ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﺭُﻭﺣﺎً ﻣِﻦْ ﺃَﻣْﺮِﻧَﺎ “এমনিভাবে আমি আমার নির্দেশক্রমে তোমার নিকট আত্মা সঞ্চারকারী বিষয় প্রেরণ করেছি। (সূরা শুরাঃ ৫২)
সব কিছুর নির্ভুল তথ্য ও জ্ঞান দান করে আল কুরআন: আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, “আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখি দু ডানা যোগে উড়ে বেড়ায় তারা তোমাদের মতই একেকটা জাতি। এই গ্রন্থে আমি কোন কিছুই লিখতে বাদ দেই নি। পরিশেষে সবাই তাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে আসবে।” (সূরা আনআমঃ ৩৮)
আল্লাহ নিজেই কুরআনের শপথ করে বলেছেন, তা অতি মর্যাদাবানঃ তিনি বলেনঃ ﻕ ﻭَﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﺍﻟْﻤَﺠِﻴﺪ “ক্বাফ। শপথ এই মর্যাদাবান কুরআনের। (সূরা ক্বাফঃ ১)
আল্লাহ তা’য়ালা বান্দাদেরকে কুরআন নিয়ে গবেষণা করার নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, যারা তা করে না তারা অন্ধ এবং বদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী। তিনি বলেন:
ﺃَﻓَﻼ ﻳَﺘَﺪَﺑَّﺮُﻭﻥَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﺃَﻡْ ﻋَﻠَﻰ ﻗُﻠُﻮﺏٍ ﺃَﻗْﻔَﺎﻟُﻬَﺎ
“তারা কি কুরআন নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করে না? না তাদের অন্তর তালাবন্ধ?” (সূরা মুহাম্মাদঃ ২৪)
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, কুরআনের সম্মান কত বেশি! কুরআন পাঠ করা, মুখস্থ করা, কুরআন নিয়ে গবেষণা করা, কুরআনের অর্থও মর্মবাণী উপলব্ধি করার চেষ্টা করা, একে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করার মর্যাদা কত উন্নত!
সুতরাং এমন কে আছে যে এ মর্যাদা লুফে নিতে চায়? কোথায় কুরআনের হাফেযগণ? কোথায় কুরআন প্রেমিক তরুণেরা? কোথায় কুরআন পাগল ঈমানদার বন্ধুগণ? আসুন, এই কুরআনের আহবানে সাড়া দেই। কুরআনের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দেই আমাদের দেহ, মন সমাজ ও পরিবেশ। গড়ে তুলি ঐশী আলোয় আলোকিত এক সুন্দর পৃথিবী।
কুরআনরে মর্যাদাঃ
কুরআন শিক্ষা করা এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়াঃ মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ ﻗُﻞْ ﻛَﻔَﻰ ﺑِﺎﻟﻠَّﻪِ ﺷَﻬِﻴﺪﺍً ﺑَﻴْﻨِﻲ ﻭَﺑَﻴْﻨَﻜُﻢْ ﻭَﻣَﻦْ ﻋِﻨْﺪَﻩُ ﻋِﻠْﻢُ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏِ “বলুন, আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং ঐ ব্যক্তি যার কাছে কিতাব (কুরআন)এর জ্ঞান আছ। (সূরা রা’দঃ ৪৩)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেনেঃ (( ﺧَﻴْﺮُﻛُﻢْ ﻣَﻦْ ﺗَﻌَﻠَّﻢَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﻭَﻋَﻠَّﻤَﻪ )) “তোমদের মধ্যে সেই উত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী)। (সহীহ বুখারী)
কুরআন পাঠ করাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
ﺍﻗْﺮَﺀُﻭﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻳَﺄْﺗِﻲ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﺷَﻔِﻴﻌًﺎ ﻟِﺄَﺻْﺤَﺎﺑِﻪِ
“তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, কুরআন কিয়ামতের দিন তার পাঠকদরে জন্য শুপারিশ করবে।” (সহীহ মুসলমি)।
– তিনি আরও বলেন: “কুরআনের অভিজ্ঞ ব্যক্তি পূত পবিত্র সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করবে। আর যে তোতলায় অথচ তার পরও কষ্টকরে কুরআন পাঠ করে সে দ্বিগুণ সোয়াবের অধিকারী হবে। (বুখারী ও মুসলিম)।
-তিনি আরও বলেন: “আল্লাহর কিতাব থেকে যে একটি হরফ পড়বে সে তার বিনিময়ে একটি সোয়াব পাবে। আর একটি সোয়াব দশটি সোয়াবের সমান। আমি তোমাদেরকে বলি না যে “আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ। (তিরমিযী, হাসান-সহীহ্)।
– তিনি আরও বলেন:
ﺇِﻥَّ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻟَﻴْﺲَ ﻓِﻲ ﺟَﻮْﻓِﻪِ ﺷَﻲْﺀٌ ﻣِﻦْ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻛَﺎﻟْﺒَﻴْﺖِ ﺍﻟْﺨَﺮِﺏِ
“যার পেটে মোটেও কুরআন নেই সে তো একটা বিরান ঘরের মত। (তিরমিযী, হাসান-সহীহ)
কুরআন পাঠের আদব:
১) সকল কাজে ইখলাস থাকা অপরিহার্য। সুতরাং পবিত্র কুরআনও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় একান্ত খালেস অন্তরে পাঠ করা আবশ্যক।
২)কুরআনের অর্থ বুঝে, সচেতনভাবে, গবেষণার দৃষ্টি নিয়ে পাঠ করা। উদাসীন মনে কুরআন পাঠ করা উচিৎ নয়।
৩) পাক-পবিত্র হয়ে মিসওয়াক করে পড়তে বসা।
৪) কুরআন পড়া শুরু করার আগে ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ্ শায়তানির রাজীম’ পড়া।
৫) ‘সূরা তাওবা’ ছাড়া প্রত্যেক সূরার প্রথমে ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করা।
৬) যথাসম্ভব সুললিত কণ্ঠে পাঠ করা। এবং ভয়-ভীতি সহকারে কান্না বিজড়িত অবস্থায় পাঠ করা।
৭) সিজদার আয়াত আসলে সিজদাহ্ করা।
৮) বায়ু নির্গত হলে, হাই উঠলে বা মনোযোগ না থাকলে কুরআন বন্ধ করা উচিৎ।
৯) পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ করা।
১০) আমল করার উদ্দেশ্যে পড়া।
১১) পড়ার সময় এ কল্পনা করা যে, আল্লাহ তা’য়ালা এ আয়াত দ্বারা আমাকেই সম্বোধন করছেন।
১২) আল্লাহর দয়া-অনুকম্পা এবং নেয়ামতরাজি সংক্রান্ত আয়াত আসলে তাঁর কাছে দয়া-অনুগ্রহ কামনা করা এবং জাহান্নামের শাস্তির আলোচনা আসলে আল্লাহর নিকট পরিত্রাণ কামনা করা।
আমাদের অবস্থা:
আমাদের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমরা কুরআনের শিক্ষা ও আদর্শ থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছি। অনেক মানুষ আদৌ কুরআন পড়তে জানে না। অনেকে পড়তে জেনেও একটি বারের জন্য কুরআন খুলে পড়তে বসার তাদের সুযোগ হয় না। অনেকে নামাযে যতটুকু পড়ে ততটুকুই। নামাযের বাইরে মোটেও পড়ে না। কেউ আবার বিপদে না পড়লে কুরআনের ধারে কাছেও যায় না। অনেকে কুরআন পড়ে কিন্তু তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে না, কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না। অনেকে কুরআন পড়ে কিন্তু আমল নেই। আরও ভয়ানক কথা হচ্ছে, আমাদের সমাজে এমন কতিপয় শিক্ষিত-মূর্খ লোকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যারা কুরআনের অনেক আয়াতকে অস্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হয় না। এরা বলে, কুরআনের আইন বর্তমান যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটাই হল, সুস্পষ্ট কুফুরী এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের পথ।
কুরআনকে কিভাবে পরিত্যাগ করা হয়?
আল্লামা ইব্ন কায়্যেম (রহঃ) বলেন, কুরআনকে কয়েক ভাবে পরিত্যাগ করা হয়:
এক: কুরআন শ্রবণ না করা, কুরআনের প্রতি বিশ্বাস পোষণ না করা এবং কুরআনের প্রতি মনোযোগ না দেয়া।
দুই: আমল না করা, বৈধ-অবৈধের প্রতি তোয়াক্কা না করা। যদিও পড়ে এবং বিশ্বাস করে।
তিন: দ্বীনের মৌলিক এবং শাখা সর্বক্ষেত্রে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা।
চার: কুরআনের অর্থ এবং ব্যাখ্যা না জানা এবং কুরআনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কি বলতে চেয়েছেন তা অনুধাবন করার চেষ্টা না করা।
কু প্রবৃত্তি মনের যাবতীয় রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করতে কুরআন থেকে সাহায্য না নেয়া।
উল্লেখিত বিষয়গুলো সবই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যেখানে আল্লাহ তা’য়াল বলেন:
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝُ ﻳَﺎ ﺭَﺏِّ ﺇِﻥَّ ﻗَﻮْﻣِﻲ ﺍﺗَّﺨَﺬُﻭﺍ ﻫَﺬَﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁَﻥَ ﻣَﻬْﺠُﻮﺭًﺍ
“রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০) যদিও উল্লেখিত দিকগুলো কোনটা বেশী কঠিন, কোনটা তুলনা মূলক হালকা।
কুরআন থেকে দূরে থাকার কারণ:
যেসব কারণে মানুষ কুরআন থাকে দূরে থাকে বা কুরআন পরিত্যাগ করে সেগুলো নিন্ম রূপ:
১) কুরআনকে সে অবিশ্বাস করে বা মিথ্যা মনে করে যদিও সে তা প্রকাশ করে না।
২) কুরআনের মর্মবাণী এবং বিস্ময়কর দিকগুলোর ব্যাপারে সে অজ্ঞ।
৩) দুনিয়া নিয়ে সে এতটাই মগ্ন যে পরকালকে ভুলে গেছে।
৪) গান-বাজনা শোনায় অভ্যস্ত বা গান-বাজনা চর্চা করে।
৫) আজ নয়, কাল থেকে শুরু করব এভাবে সময় ক্ষেপণ করতে থাকা।
৬) কুরআন বাদ দিয়ে অন্য জ্ঞান চর্চায় সময় ব্যয় করা। যেমন, কতিপয় মানুষ ইসলামী জ্ঞান চর্চার নামে হাদীস, ফিক্হ, ইসলামী সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে সার্বক্ষণিক সময় ব্যয় করে কিন্তু একবারও কুরআন পড়তে বসে না। এটা খুবই দূষণীয়। বরং উচিৎ হল, এসবের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ, কুরআন বাদ দিয়ে কোন জ্ঞানই অর্জন করা সম্ভব নয়।
কুরআনের ছোঁয়ায় বদলে যাক জীবন:
আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রা:) বলেন, “ক্বারী তথা কুরআন প্রেমিক মানুষের তো এমন হওয়া উচিৎ, গভীর রাতে মানুষ যখন ঘুমের ঘোরে ডুবে থাকে তখন সে কুরআন তেলাওয়াত করে। দিনের বেলায় সবাই যখন খাবার-দাবারে লিপ্ত থাকে তখন সে কুরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সবাই যখন হাঁসি-তামাশায় মত্ত থাকে তখন সে আল্লাহর দরবারে চোখের পানিতে বুক ভাষায়। মানুষ যখন নির্বিঘ্নে সবার সাথে মিশে তখন সে পরহেযগারীতা অবলম্বন করে এবং ভালো মানুষ ছাড়া খারাপ মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে। মানুষ যখন অন্যের দোষ চর্চা এবং অনর্থক আলাপচারীটায় সময় কাটায় তখন সে নীরবতার ভূমিকা পালন করে। মানুষ যখন দাম্ভিক এবং অহংকারপূর্ণ আচরণ করে তখন সে অতি নম্র ও ভদ্র স্বভাবের পরিচয় দেয়। অন্যেরা যখন আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে তখন সে বিভোর থাকে পরকালের চিন্তায়।
হে আল্লাহ! হে পরম দয়ালু!! তুমি আমাদেরকে কুরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ বানাও। কুরআনের ছায়া তলে গড়ার তাওফিক দাও আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, সংস্কৃতি অর্থনীতি সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন॥
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব
জুবাইল দা’ওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব
আবদুল্লাহিল হাদী বিন আবদুল জলীল
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা: আল কুরআন মহান আল্লাহর বাণীর অপূর্ব সমাহার বিস্ময়কর এক গ্রন্থের নাম। আল কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সংরক্ষিত এক সংবিধান। এই কুরআন যেমন সমগ্র মানবজাতির মানসিক সংশয়, সন্দেহ, অস্পষ্টতা, কুপ্রবৃত্তি, লোভ-লালসা নামক নানারকম রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের অব্যর্থ মহৌষধ ঠিক তেমনি দৈহিক রোগ-ব্যাধি, বেদনা, কষ্ট-ক্লেশ এবং জীবন চলার পথের সকল অন্ধকার বিদূরিত করার এক অনবদ্য নির্দেশিকা। এই কুরআন হল,
সত্য-মিথ্যা এবং বৈধ-অবৈধের সীমা-রেখা নির্ধারণের এক সুউচ্চ মাইল ফলক, সুখ সমৃদ্ধ জীবনের বিশ্বস্ত ঠিকানা এবং পশ্চাদপদতা, দুর্ভাগ্য ও হতাশার গ্লানি থেকে মুক্তির অনুপম গাইড লাইন।
বিশ্ববাসীর প্রতি আল কুরআনের চ্যালেঞ্জ:
আল কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত বিশ্বের এক চিরন্তন বিস্ময়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমগ্র মানব ও দানব জাতির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন-কুরআনের মত আরেকটি গ্রন্থ তারা সবাই মিলে রচনা করুক তো। কিন্তু কাল প্রবাহে সবাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
ﻗُﻞْ ﻟَﺌِﻦِ ﺍﺟْﺘَﻤَﻌَﺖ ﺍﻟْﺄِﻧْﺲُ ﻭَﺍﻟْﺠِﻦُّ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻥْ ﻳَﺄْﺗُﻮﺍ ﺑِﻤِﺜْﻞِ ﻫَﺬَﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻻ ﻳَﺄْﺗُﻮﻥَ ﺑِﻤِﺜْﻠِﻪِ ﻭَﻟَﻮْ ﻛَﺎﻥَ ﺑَﻌْﻀُﻬُﻢْ ﻟِﺒَﻌْﺾٍ ﻇَﻬِﻴﺮﺍً
“বলুন, যদি মানব ও জিন সকলে কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য একত্রিত হয়, এবং তারা পরস্পরে সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা এর অনুরূপ রচনা করতে পারবে না।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৮৮)
আবার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে, পুরো গ্রন্থ নয়; কুরআনের মত দশটি সূরা তারা রচনা করুক তো। কিন্তু তাতেও সবাই ব্যর্থ হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
ﺃَﻡْ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﺍﻓْﺘَﺮَﺍﻩُ ﻗُﻞْ ﻓَﺄْﺗُﻮﺍ ﺑِﻌَﺸْﺮِ ﺳُﻮَﺭٍ ﻣِﺜْﻠِﻪِ ﻣُﻔْﺘَﺮَﻳَﺎﺕٍ ﻭَﺍﺩْﻋُﻮﺍ ﻣَﻦِ ﺍﺳْﺘَﻄَﻌْﺘُﻢْ ﻣِﻦْ ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺻَﺎﺩِﻗِﻴﻦَ
“তারা কি বলে কুরআন সে (অর্থাৎ নবী মোহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে তৈরি করেছে? আপনি বলে দিন, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আস। আর আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো ডেকে নাও। যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে।” (সূরা হুদ: ১৩)
আবারো চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করা হয়েছে, মাত্র একটি সূরা তারা রচনা করুক। কিন্তু এতেও তারা ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছে । আল্লাহ তায়ালা বলেন:
ﻭَﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻓِﻲ ﺭَﻳْﺐٍ ﻣِﻤَّﺎ ﻧَﺰَّﻟْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﻋَﺒْﺪِﻧَﺎ ﻓَﺄْﺗُﻮﺍ ﺑِﺴُﻮﺭَﺓٍ ﻣِّﻦْ ﻣِﺜْﻠِﻪِ ﻭَﺍﺩْﻋُﻮﺍ ﺷُﻬَﺪَﺍﺀَﻛُﻢْ ﻣِﻦْ ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺻَﺎﺩِﻗِﻴﻦ
“আমি আমার বান্দার নিকট যা অবতীর্ণ করেছি সে ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে তবে এর মত একটিমাত্র সূরা রচনা করে নিয়ে আস তো। এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহায্যকারীদেরকেও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।” (সূরা বাকারাঃ ২৩)
আল কুরআন বরকতময় এক গ্রন্থের নাম:
যাবতীয় কল্যাণ, সর্বপ্রকার জ্ঞান-গরিমা, প্রজ্ঞা ও রহস্যের আধার হল আল কুরআন। একে অনুসরণ করেই দুনিয়া ও আখেরাতে পাওয়া যায় সুখের সন্ধান, মেলে সঠিক পথের দিশা। পক্ষান্তরে কুরআন থেকে দূরে থাকলে, কুরআনকে একমাত্র সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করলে নানারকম দুর্ভাগ্য, দুশ্চিন্তা, হতাশা, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি মানব জীবনকে ঘিরে ফেলে, প্রতি পদে নেমে আসে গহীন অন্ধকার।
কুরআন দেয় নিজের পরিচয়:
কুরআন সকল রোগের প্রতিষেধক এবং বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপঃ আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ ﻭَﻧُﻨَﺰِّﻝُ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻣَﺎ ﻫُﻮَ ﺷِﻔَﺎﺀٌ ﻭَﺭَﺣْﻤَﺔٌ ﻟِﻠْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦ “আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের প্রতিষেধক এবং মুমিনদের জন্য রহমত।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৮২)
সত্যের দিশারী এবং আলোকবর্তীকাঃ আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “এই কুরআন দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা যারা তাঁর সন্তষ্টি কামনা করে তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে প্রদান করেন সরল-সোজা পথের দিশা।” (সূরা মায়িদাহঃ ১৬)
সত্য পথের পথিকদের মহাপুরস্কারের শুভ সংবাদ দেয় কুরআনঃ ইরশাদ হচ্ছেঃ “আল্লাহ এ(জান্নাতেরই) শুভ সংবাদ প্রদান করে সে সব বান্দাকে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে। বলুন, আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না। শুধু চাই আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্য। কেউ উত্তম কাজ করলে আমি তার সোয়াব বৃদ্ধি করে দেই। আল্লাহ তো ক্ষমাকারী এবং গুণগ্রাহী।” (সূরা শূরাঃ ২৩)
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার: আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন:
ﺫَﻟِﻚَ ﻧَﺘْﻠُﻮﻩُ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺂﻳﺎﺕِ ﻭَﺍﻟﺬِّﻛْﺮِ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴﻢ
“আমি তোমাদেরকে এসমস্ত আয়াত এবং বিজ্ঞানময় উপদেশ বানী পড়ে শুনাই। (সূরা আলে ইমরান: ৫৮)
আত্বা ও জীবনের স্পন্দনঃ আল্লাহ বলেনঃ ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﺭُﻭﺣﺎً ﻣِﻦْ ﺃَﻣْﺮِﻧَﺎ “এমনিভাবে আমি আমার নির্দেশক্রমে তোমার নিকট আত্মা সঞ্চারকারী বিষয় প্রেরণ করেছি। (সূরা শুরাঃ ৫২)
সব কিছুর নির্ভুল তথ্য ও জ্ঞান দান করে আল কুরআন: আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, “আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখি দু ডানা যোগে উড়ে বেড়ায় তারা তোমাদের মতই একেকটা জাতি। এই গ্রন্থে আমি কোন কিছুই লিখতে বাদ দেই নি। পরিশেষে সবাই তাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে আসবে।” (সূরা আনআমঃ ৩৮)
আল্লাহ নিজেই কুরআনের শপথ করে বলেছেন, তা অতি মর্যাদাবানঃ তিনি বলেনঃ ﻕ ﻭَﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﺍﻟْﻤَﺠِﻴﺪ “ক্বাফ। শপথ এই মর্যাদাবান কুরআনের। (সূরা ক্বাফঃ ১)
আল্লাহ তা’য়ালা বান্দাদেরকে কুরআন নিয়ে গবেষণা করার নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, যারা তা করে না তারা অন্ধ এবং বদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী। তিনি বলেন:
ﺃَﻓَﻼ ﻳَﺘَﺪَﺑَّﺮُﻭﻥَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﺃَﻡْ ﻋَﻠَﻰ ﻗُﻠُﻮﺏٍ ﺃَﻗْﻔَﺎﻟُﻬَﺎ
“তারা কি কুরআন নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করে না? না তাদের অন্তর তালাবন্ধ?” (সূরা মুহাম্মাদঃ ২৪)
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, কুরআনের সম্মান কত বেশি! কুরআন পাঠ করা, মুখস্থ করা, কুরআন নিয়ে গবেষণা করা, কুরআনের অর্থও মর্মবাণী উপলব্ধি করার চেষ্টা করা, একে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করার মর্যাদা কত উন্নত!
সুতরাং এমন কে আছে যে এ মর্যাদা লুফে নিতে চায়? কোথায় কুরআনের হাফেযগণ? কোথায় কুরআন প্রেমিক তরুণেরা? কোথায় কুরআন পাগল ঈমানদার বন্ধুগণ? আসুন, এই কুরআনের আহবানে সাড়া দেই। কুরআনের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দেই আমাদের দেহ, মন সমাজ ও পরিবেশ। গড়ে তুলি ঐশী আলোয় আলোকিত এক সুন্দর পৃথিবী।
কুরআনরে মর্যাদাঃ
কুরআন শিক্ষা করা এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়াঃ মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ ﻗُﻞْ ﻛَﻔَﻰ ﺑِﺎﻟﻠَّﻪِ ﺷَﻬِﻴﺪﺍً ﺑَﻴْﻨِﻲ ﻭَﺑَﻴْﻨَﻜُﻢْ ﻭَﻣَﻦْ ﻋِﻨْﺪَﻩُ ﻋِﻠْﻢُ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏِ “বলুন, আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং ঐ ব্যক্তি যার কাছে কিতাব (কুরআন)এর জ্ঞান আছ। (সূরা রা’দঃ ৪৩)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেনেঃ (( ﺧَﻴْﺮُﻛُﻢْ ﻣَﻦْ ﺗَﻌَﻠَّﻢَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﻭَﻋَﻠَّﻤَﻪ )) “তোমদের মধ্যে সেই উত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী)। (সহীহ বুখারী)
কুরআন পাঠ করাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
ﺍﻗْﺮَﺀُﻭﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻳَﺄْﺗِﻲ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﺷَﻔِﻴﻌًﺎ ﻟِﺄَﺻْﺤَﺎﺑِﻪِ
“তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, কুরআন কিয়ামতের দিন তার পাঠকদরে জন্য শুপারিশ করবে।” (সহীহ মুসলমি)।
– তিনি আরও বলেন: “কুরআনের অভিজ্ঞ ব্যক্তি পূত পবিত্র সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করবে। আর যে তোতলায় অথচ তার পরও কষ্টকরে কুরআন পাঠ করে সে দ্বিগুণ সোয়াবের অধিকারী হবে। (বুখারী ও মুসলিম)।
-তিনি আরও বলেন: “আল্লাহর কিতাব থেকে যে একটি হরফ পড়বে সে তার বিনিময়ে একটি সোয়াব পাবে। আর একটি সোয়াব দশটি সোয়াবের সমান। আমি তোমাদেরকে বলি না যে “আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ। (তিরমিযী, হাসান-সহীহ্)।
– তিনি আরও বলেন:
ﺇِﻥَّ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻟَﻴْﺲَ ﻓِﻲ ﺟَﻮْﻓِﻪِ ﺷَﻲْﺀٌ ﻣِﻦْ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻛَﺎﻟْﺒَﻴْﺖِ ﺍﻟْﺨَﺮِﺏِ
“যার পেটে মোটেও কুরআন নেই সে তো একটা বিরান ঘরের মত। (তিরমিযী, হাসান-সহীহ)
কুরআন পাঠের আদব:
১) সকল কাজে ইখলাস থাকা অপরিহার্য। সুতরাং পবিত্র কুরআনও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় একান্ত খালেস অন্তরে পাঠ করা আবশ্যক।
২)কুরআনের অর্থ বুঝে, সচেতনভাবে, গবেষণার দৃষ্টি নিয়ে পাঠ করা। উদাসীন মনে কুরআন পাঠ করা উচিৎ নয়।
৩) পাক-পবিত্র হয়ে মিসওয়াক করে পড়তে বসা।
৪) কুরআন পড়া শুরু করার আগে ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ্ শায়তানির রাজীম’ পড়া।
৫) ‘সূরা তাওবা’ ছাড়া প্রত্যেক সূরার প্রথমে ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করা।
৬) যথাসম্ভব সুললিত কণ্ঠে পাঠ করা। এবং ভয়-ভীতি সহকারে কান্না বিজড়িত অবস্থায় পাঠ করা।
৭) সিজদার আয়াত আসলে সিজদাহ্ করা।
৮) বায়ু নির্গত হলে, হাই উঠলে বা মনোযোগ না থাকলে কুরআন বন্ধ করা উচিৎ।
৯) পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ করা।
১০) আমল করার উদ্দেশ্যে পড়া।
১১) পড়ার সময় এ কল্পনা করা যে, আল্লাহ তা’য়ালা এ আয়াত দ্বারা আমাকেই সম্বোধন করছেন।
১২) আল্লাহর দয়া-অনুকম্পা এবং নেয়ামতরাজি সংক্রান্ত আয়াত আসলে তাঁর কাছে দয়া-অনুগ্রহ কামনা করা এবং জাহান্নামের শাস্তির আলোচনা আসলে আল্লাহর নিকট পরিত্রাণ কামনা করা।
আমাদের অবস্থা:
আমাদের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমরা কুরআনের শিক্ষা ও আদর্শ থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছি। অনেক মানুষ আদৌ কুরআন পড়তে জানে না। অনেকে পড়তে জেনেও একটি বারের জন্য কুরআন খুলে পড়তে বসার তাদের সুযোগ হয় না। অনেকে নামাযে যতটুকু পড়ে ততটুকুই। নামাযের বাইরে মোটেও পড়ে না। কেউ আবার বিপদে না পড়লে কুরআনের ধারে কাছেও যায় না। অনেকে কুরআন পড়ে কিন্তু তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে না, কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না। অনেকে কুরআন পড়ে কিন্তু আমল নেই। আরও ভয়ানক কথা হচ্ছে, আমাদের সমাজে এমন কতিপয় শিক্ষিত-মূর্খ লোকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যারা কুরআনের অনেক আয়াতকে অস্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হয় না। এরা বলে, কুরআনের আইন বর্তমান যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটাই হল, সুস্পষ্ট কুফুরী এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের পথ।
কুরআনকে কিভাবে পরিত্যাগ করা হয়?
আল্লামা ইব্ন কায়্যেম (রহঃ) বলেন, কুরআনকে কয়েক ভাবে পরিত্যাগ করা হয়:
এক: কুরআন শ্রবণ না করা, কুরআনের প্রতি বিশ্বাস পোষণ না করা এবং কুরআনের প্রতি মনোযোগ না দেয়া।
দুই: আমল না করা, বৈধ-অবৈধের প্রতি তোয়াক্কা না করা। যদিও পড়ে এবং বিশ্বাস করে।
তিন: দ্বীনের মৌলিক এবং শাখা সর্বক্ষেত্রে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা।
চার: কুরআনের অর্থ এবং ব্যাখ্যা না জানা এবং কুরআনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কি বলতে চেয়েছেন তা অনুধাবন করার চেষ্টা না করা।
কু প্রবৃত্তি মনের যাবতীয় রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করতে কুরআন থেকে সাহায্য না নেয়া।
উল্লেখিত বিষয়গুলো সবই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যেখানে আল্লাহ তা’য়াল বলেন:
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝُ ﻳَﺎ ﺭَﺏِّ ﺇِﻥَّ ﻗَﻮْﻣِﻲ ﺍﺗَّﺨَﺬُﻭﺍ ﻫَﺬَﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁَﻥَ ﻣَﻬْﺠُﻮﺭًﺍ
“রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০) যদিও উল্লেখিত দিকগুলো কোনটা বেশী কঠিন, কোনটা তুলনা মূলক হালকা।
কুরআন থেকে দূরে থাকার কারণ:
যেসব কারণে মানুষ কুরআন থাকে দূরে থাকে বা কুরআন পরিত্যাগ করে সেগুলো নিন্ম রূপ:
১) কুরআনকে সে অবিশ্বাস করে বা মিথ্যা মনে করে যদিও সে তা প্রকাশ করে না।
২) কুরআনের মর্মবাণী এবং বিস্ময়কর দিকগুলোর ব্যাপারে সে অজ্ঞ।
৩) দুনিয়া নিয়ে সে এতটাই মগ্ন যে পরকালকে ভুলে গেছে।
৪) গান-বাজনা শোনায় অভ্যস্ত বা গান-বাজনা চর্চা করে।
৫) আজ নয়, কাল থেকে শুরু করব এভাবে সময় ক্ষেপণ করতে থাকা।
৬) কুরআন বাদ দিয়ে অন্য জ্ঞান চর্চায় সময় ব্যয় করা। যেমন, কতিপয় মানুষ ইসলামী জ্ঞান চর্চার নামে হাদীস, ফিক্হ, ইসলামী সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে সার্বক্ষণিক সময় ব্যয় করে কিন্তু একবারও কুরআন পড়তে বসে না। এটা খুবই দূষণীয়। বরং উচিৎ হল, এসবের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ, কুরআন বাদ দিয়ে কোন জ্ঞানই অর্জন করা সম্ভব নয়।
কুরআনের ছোঁয়ায় বদলে যাক জীবন:
আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রা:) বলেন, “ক্বারী তথা কুরআন প্রেমিক মানুষের তো এমন হওয়া উচিৎ, গভীর রাতে মানুষ যখন ঘুমের ঘোরে ডুবে থাকে তখন সে কুরআন তেলাওয়াত করে। দিনের বেলায় সবাই যখন খাবার-দাবারে লিপ্ত থাকে তখন সে কুরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সবাই যখন হাঁসি-তামাশায় মত্ত থাকে তখন সে আল্লাহর দরবারে চোখের পানিতে বুক ভাষায়। মানুষ যখন নির্বিঘ্নে সবার সাথে মিশে তখন সে পরহেযগারীতা অবলম্বন করে এবং ভালো মানুষ ছাড়া খারাপ মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে। মানুষ যখন অন্যের দোষ চর্চা এবং অনর্থক আলাপচারীটায় সময় কাটায় তখন সে নীরবতার ভূমিকা পালন করে। মানুষ যখন দাম্ভিক এবং অহংকারপূর্ণ আচরণ করে তখন সে অতি নম্র ও ভদ্র স্বভাবের পরিচয় দেয়। অন্যেরা যখন আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে তখন সে বিভোর থাকে পরকালের চিন্তায়।
হে আল্লাহ! হে পরম দয়ালু!! তুমি আমাদেরকে কুরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ বানাও। কুরআনের ছায়া তলে গড়ার তাওফিক দাও আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, সংস্কৃতি অর্থনীতি সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন॥
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব
জুবাইল দা’ওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব
0 Comments